মালদা, 28 এপ্রিল: হাতে খোলা পিস্তল নিয়ে ভরা ক্লাসরুমে দাপাদাপি, পুলিশের হাতে ধরা পড়া, এলাকাবাসীর রোষের প্রহার, থানা থেকে আদালতে যাওয়ার পথে সন্তান ফিরে পাওয়ার আকুতি, এসবই কি তিন বছর আগে ভেঙে যাওয়া দাম্পত্য সম্পর্ক আবার জোড়া লাগাতে চলেছে ? তেমনই আভাস মিলেছে মালদার স্কুলে বন্দুকবাজির ঘটনায় ধৃত দেব বল্লভের স্ত্রীর গলায় ৷ পরিষ্কারই জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে তিনি স্বামীর পাশে দাঁড়াতে চান ৷ শ্বশুরকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চান ৷ এমনকি স্বামীর চিকিৎসাও করাতে চান তিনি ৷ কিন্তু কে বা কারা বারবার তাঁর স্বামীকে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করছে, সেটা তিনি জানতে চান ৷
গত বুধবার পুরাতন মালদার মুচিয়া অঞ্চল চন্দ্রমোহন হাইস্কুলে কার্তুজ ভর্তি পিস্তল হাতে ঢুকে পড়েন স্থানীয় নেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা দেব বল্লভ ৷ সঙ্গে ছিল ড্যাগার এবং পেট্রল বোমাও ৷ হাতে থাকা কাগজের লেখা চিৎকার করে পড়ে তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে ৷ তাদের ফিরে পেতে তিনি একাধিকবার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন ৷ কিন্তু পুলিশ তাঁর কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে না ৷ তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান ৷ সেদিন সপ্তম শ্রেণির ক্লাসরুমে এক ঘণ্টার বেশি সময় তিনি এই আবেদন করেই কাটিয়ে দেন ৷ তারপর পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ৷ এই সময়ের মধ্যে তিনি হুমকি দিয়েছেন বটে, কিন্তু কাউকে গুলি করেননি ৷ এমনকি ভয় দেখাতে শূন্যেও গুলি চালাননি ৷ গতকাল মালদা থানা থেকে আদালতে যাওয়ার পথেও তিনি একই আকুতি করে গিয়েছেন যে স্ত্রী-সন্তানকে ফেরত চান ৷
আরও পড়ুন : পড়ুয়াদের বাঁচাতে বন্দুকবাজের উপর ঝাঁপ, ইটিভি ভারতে অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন বাস্তবের 'সিংঘম'
গত বছর 26 জুন প্রায় এমনই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন দেববাবু ৷ নিজের ঘরে হাতে খোলা পিস্তল, টেবিলে পেট্রল বোমা রেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি স্ত্রী-সন্তানকে ফিরে পেতে চান ৷ তার জন্য তিনি প্রয়োজনে যে কাউকে খুন করতে পারেন ৷ সেই বার্তার ভিত্তিতে মালদা থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ৷ পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান ৷ নেমুয়া গ্রামের প্রমীলা মণ্ডল, বিশাখা মণ্ডল-সহ প্রতিটি বাসিন্দা থেকে শুরু করে কোনও যোগাযোগ না থাকা বোন অনিমা মণ্ডলও জানাচ্ছেন, দেববাবু এমন ছিলেন না ৷ ভালো মানুষ ৷ কৃষিকাজ নিয়েই থাকেন ৷ গ্রামের কারও সঙ্গে কোনওদিন ঝামেলা হয়নি তাঁর ৷ কিন্তু স্ত্রী-পুত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি খানিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ৷
স্বামীর ঘর ছাড়ার পর দেববাবুর স্ত্রী রীতা বল্লভ রায় বামনগোলার পাকুয়াহাটে থাকেন ৷ পরে একমাত্র ছেলে রুদ্রকেও স্বামীর ঘর থেকে বের করে আনেন ৷ পুরাতন মালদা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য হলেও গত তিন বছর ধরে তিনি দফতরে সেভাবে যান না বলেই খবর ৷ বৃহস্পতিবার রাতে তিনি বলেন, "বিয়ের পরই আমার নজরে আসে, ও খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন ৷ শাশুড়ির কাছে জানতে পেরেছিলাম, ছোট থেকেই ওর মাথার সমস্যা দেখা দেয় ৷ তখনই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই সমস্যা বাড়বে ৷ আমি রাজনীতিতে ঢোকার পর ওর মাথার সমস্যা আরও বেড়ে যায় ৷ ও কিন্তু ভীষণ সিধেসাধা ছেলে ৷ যে যা বোঝায়, ও সেটাই করে ৷ তিন বছর ধরে আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই ৷ তাই ও কেন পিস্তল হাতে স্কুলে গেল, আমি বলতে পারব না ৷ সেটা ওর পরিবারের লোকজন কিংবা কাছের মানুষজনই বলতে পারবেন ৷ কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার প্রশ্ন, ও এমন কেন করছে ? বারবার ওকে কে অস্ত্র সরবরাহ করছে ? তবে ও দাবি করলেও আমাকে কিংবা আমার ছেলেকে কেউ অপহরণ করেনি ৷ হয়তো ওকে এটাও কেউ বোঝাচ্ছে ৷"
রীতাদেবী আরও বলেন, "ওর পরিবারে অনেক লোকজন রয়েছে ৷ আমি বারবার ওকে বলেছিলাম, ওর পরিবারের লোকের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই ৷ কিন্তু তা হয়নি ৷ এত ভালো পরিবার হলেও কেউ এই বিপদে ওর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না ৷ বাধ্য হয়ে আমি ভাবছি, আমিই ওর চিকিৎসা শুরু করব ৷ আমি ওর কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করব ৷ একটা ভালো মানুষ বিপথে চলে যাচ্ছে ৷ আমি আমার সাধ্যমতো ওকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব ৷ জীবনের ভয়ে আমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম ৷ আমার মতো বিপদের মুখে পড়তে হলে সবাইকেই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হত ৷ এখানে রাজনীতির কোনও বিষয় নেই ৷ তবে আমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি ৷ আমার বৃদ্ধ এবং অসুস্থ শ্বশুরমশাই আমাকে দেখতে চেয়েছেন ৷ আমি তাঁর কাছে যাব ৷ শ্বশুরমশাইকে নিয়ে আমি স্বামীর সঙ্গেও দেখা করতে যাব ৷"
আরও পড়ুন : হাড়হিম করা ঘটনা মালদার স্কুলে, পিস্তল দেখিয়ে পড়ুয়াদের পণবন্দির চেষ্টা যুবকের !