মালদা, 24 সেপ্টেম্বর : জনরোষের শিকার হলেন বন্যাত্রাণের (Flood Relief Corruption) টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা । তাঁর স্ত্রী আবার শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্য । অভিযোগ, এলাকাবাসীর নামে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ করেছেন ওই নেতা । আজ গণপিটুনির (TMC Leader Lynched) হাত থেকে তাঁকে উদ্ধার করতে গেলে ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীদের হাতে আক্রান্ত হয় পুলিশও । ঘটনাটি ঘটেছে মালদার (Malda) হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লকের বরুই গ্রাম পঞ্চায়েতের চোপালমোড় এলাকায় । গোটা ঘটনাকে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছেন ব্লক তৃণমূল সভাপতি ।
2017 সালে উত্তর মালদায় ভয়াবহ বন্যা হয় । কয়েক হাজার বাড়ি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় । আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য বাড়ি । সেই সময় রাজ্য সরকার ঘোষণা করে, যাঁদের বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের 70 হাজার টাকা এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের 3300 টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে । সেইমতো পঞ্চায়েতের তরফে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয় । সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত 14 হাজার মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিয়েও দেয় রাজ্য সরকার । কিন্তু অভিযোগ ওঠে, প্রকৃত উপভোক্তারা সরকারি এই ক্ষতিপূরণ পাননি । এই টাকায় ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়েছে । সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে বরুই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ।
এই পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের মোস্তাক আলম কলকাতা হাইকোর্টে এ নিয়ে একটি মামলা করেন । সেই মামলায় প্রমাণ হিসাবে মোস্তাক সাহেবের আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে যে নথি পেশ করেন, তাতে দেখা যায়, কয়েক হাজার মানুষের একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোথাও দু’বার, আবার কোথাও তিনবার ত্রাণের টাকা ঢুকেছে । সাত হাজার উপভোক্তার একই মোবাইল নম্বর দেখানো হয়েছে । সব নথি দেখে সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এ নিয়ে রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে । আদালতে দুর্নীতির বিষয়টি মেনে নেয় রাজ্য সরকারও ।
হাইকোর্ট এই কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দেয় । হাইকোর্টের নির্দেশে হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লকের বিডিও বিজয় গিরি বরুই গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান সোনামণি সাহা-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হরিশ্চন্দ্রপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন । তার ভিত্তিতে এখনও পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ । তবে মূল অভিযুক্ত সোনামণি সাহা পলাতক । প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই কেলেঙ্কারিতে দুর্নীতি করা অর্থের পরিমাণ প্রায় 75 লাখ 94 হাজার 800 টাকা ।
আরও পড়ুন: Goa TMC : লক্ষ্য বাইশের বিধানসভা, গোয়ায় ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল
প্রকৃত উপভোক্তাদের অভিযোগ, একই নামে একাধিক অ্যাকাউন্ট এবং সে সব অ্যাকাউন্ট থেকে ত্রাণের টাকা তুলে নেওয়ার দায়ে পুলিশ তাঁদের হেনস্থা করছে । নিরীহ গ্রামবাসীদের থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । অথচ তাঁরা এ সব কিছুই জানেন না । আজ চোপালমোড় এলাকায় এমনই এক অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা কুণালকান্তি রায়কে ধরে ফেলেন প্রকৃত উপভোক্তারা । বেশ কিছুদিন তিনি গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন । আজ তাঁকে গণপিটুনি দেওয়া হয় । খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করতে গেলে ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা পুলিশের সঙ্গেও ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন । পুলিশের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয় । শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে পুলিশকর্মীরা কুণালকান্তি রায়কে থানায় নিয়ে যান ।
এক উপভোক্তা প্রফুল্ল দাস বলেন, “কয়েকদিন আগে আমাকে দোকান থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় । থানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে পুলিশ জানায়, আমার নামে একাধিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে । অথচ আমার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই । পুলিশ আমাকে আরও বলে, আমি নাকি একাধিক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছি । আমি এক টাকাও কোথাও থেকে তুলিনি । আমার টাকাও নেই । পুলিশ আমাকে পঞ্চায়েত সচিব আর প্রধানকে থানায় নিয়ে যেতে বলে । কিন্তু তাঁরা তো থানায় যাবেন না । আমি পুলিশকে সে কথা বলতেই তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি বন্যাত্রাণের কোনও টাকা পেয়েছি কি না । কিন্তু আমি ত্রাণের একটি পয়সাও পাইনি । থানা থেকে ফিরে আমি গ্রামের সবাইকে বিষয়টি জানাই । তখনই জানতে পারি, গ্রামের অনেক মানুষের নামে পঞ্চায়েত সদস্য একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সেসব অ্যাকাউন্টে সরকারি ত্রাণের টাকা ঢোকানো হয়েছে। ওরাই সব টাকা তুলে নিয়েছে ।”
আরেক গ্রামবাসী অশোকা দাস বলেন, “ত্রাণের একটা টাকাও পাইনি । কিন্তু পুলিশ আমাদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে । আমরা নাকি অ্যাকাউন্ট থেকে একাধিকবার টাকা তুলেছি । আজ পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামীকে দেখতে পেয়ে ধরে রেখেছি। তাঁকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে মারতে ওঠেন । আমার দাদা আমাকে বাঁচান । ত্রাণের 3300 টাকা একবার আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসেছিল । তার মধ্যে পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামী 500 টাকা আগেই নিয়ে নেন । এমন কেন হবে ?”
আরও পড়ুন : TMC ASSAM : সুস্মিতা দেবের হাত ধরে অসমে ঘাসফুল ফোটানোর অভিযানে তৃণমূল
স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ দাস বলেছেন, “গ্রামের প্রফুল্ল দাসকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল । তাঁর নামে 70 হাজার টাকা পঞ্চায়েত সদস্য তুলে নিয়েছেন । তাঁর নামে তিনি তিনটি অ্যাকাউন্ট করেছেন । আমার পরিবারের অনেকের নামেও একাধিক গোপন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে । যাঁদের অ্যাকাউন্টে 70 হাজার টাকা ঢুকেছে, তাঁদের 3300 টাকার কথা বলা হয়েছে । তার মধ্যেও প্রত্যেকের কাছ থেকে 500 টাকা করে নিয়েছে । মেম্বারের স্বামী কুণালই এর সঙ্গে জড়িত । তাই আজ আমরা ওঁকে ধরেছি । আমরা ওঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেব ।”
নিগৃহীত তৃণমূল নেতা কুণালকান্তি রায়ের বক্তব্য, “আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে 3300 টাকা করে দেওয়া হয়েছে । এখন দেখা যাচ্ছে, একেক জনের নামে একাধিক অ্যাকাউন্ট । এ নিয়ে আজ আমাকে স্থানীয় মানুষজন জিজ্ঞাসাবাদ করেন । কিন্তু আমরা এসব কিছু জানি না । তবে এখানে কোনও দুর্নীতি হয়নি । বিরোধী দলনেতা এ সব করেছেন । বরুই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ও তাঁর স্বামীও এই দুর্নীতিতে জড়িত । আজ গ্রামবাসীরা আমাকে মারধর করেছে ।”
আরও পড়ুন : Srijib Biswas : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরাজিত হলে দলটাই উঠে যাবে, দাবি শ্রীজীব বিশ্বাসের
হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লক তৃণমূল সভাপতি এই ঘটনায় বিরোধীদের হাত দেখছেন । তিনি বলেন, “এর পিছনে কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপির হাত রয়েছে । তারাই কিছু লোককে উসকে দিয়ে আমাদের পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামীকে মারধর করিয়েছে । প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি । যখন ঘটনাটি ঘটেছিল, তখন ওই পঞ্চায়েতে কংগ্রেসের বোর্ড ছিল । 2017 সালে ক্ষতিগ্রস্তদের দুটি তালিকা তৈরি হয়েছিল । কংগ্রেস ও তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আলাদাভাবে তালিকা তৈরি করেন । কংগ্রেসিরা তালিকায় একজনের নাম একাধিকবার ঢুকিয়েছিল । তারাই এই দুর্নীতি করেছিল । এখন আমাদের কাঁধে তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে । 2018 সালে তৃণমূল বোর্ডের আমলে যেহেতু উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকানো হয়েছিল, তাই রাজ্য সরকারকেও এর দায় মেনে নিতে হয়েছে ।”