মালদা, 28 অগাস্ট : তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত ইংরেজবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান নীহাররঞ্জন ঘোষের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলেন তাঁরই দলের 15 কাউন্সিলর ৷ তাঁদের স্বাক্ষর সম্বলিত সেই অনাস্থা প্রস্তাব জমা পড়েছে জেলাশাসক, মহকুমাশাসকের দপ্তর ও পৌরসভায় ৷ যদিও এবিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন নীহারবাবু ৷
2017 সালের 17 জানুয়ারি ইংরেজবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন নীহারবাবু । রাজনীতিতে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরিকে সরিয়ে চেয়ারম্যান হন তিনি । সেই সময় তাঁকে সমর্থন করেছিলেন 29 ওয়ার্ড বিশিষ্ট এই পৌরসভার অধিকাংশ কাউন্সিলর । সম্প্রতি কাউন্সিলরদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে । পৌরসভার বেশিরভাগ কাউন্সিলরই তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেন । এমন কী ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল সরকারও নীহারবাবুর বিরুদ্ধে সরব হন । তখনই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, নীহারবাবু চেয়ারম্যান পদে আর ক'দিন? কারণ, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এই শহর গত সাড়ে 4 বছরে দু'জন চেয়ারম্যান দেখেছে । সেই পরিস্থিতিতে ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নীহারবাবু দাবি করেছিলেন, পৌরসভায় তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেন । দলের মধ্যে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি ছিল তাঁর । তবুও কাউন্সিলরদের একাংশ কেন তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তা তিনি জানেন না ।
পৌরসভার অন্দরে এই দলাদলির মধ্যেই গত পরশু কলকাতায় চলে যান নীহারবাবু । তিনি ইংরেজবাজার কেন্দ্রের বিধায়কও বটে । তাঁর অনুপস্থিতিতেই আজ নীহারবাবুর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন পৌরসভার সিংহভাগ কাউন্সিলর । যে 15 জন কাউন্সিলর তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন তাঁরা হলেন, 4 নম্বর ওয়ার্ডের অশোক সাহা, 5 নম্বর ওয়ার্ডের সুমিতা ব্যানার্জি, 7 নম্বর ওয়ার্ডের বরুণ সরদার, 8 নম্বর ওয়ার্ডের কাকলি চৌধুরি, 10 নম্বর ওয়ার্ডের কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরি, 11 নম্বর ওয়ার্ডের রাজশ্রী দে, 12 নম্বর ওয়ার্ডের প্রসেনজিৎ দাস, 14 নম্বর ওয়ার্ডের শম্পা সাহা (বসাক), 18 নম্বর ওয়ার্ডের আশিস কুণ্ডু, 19 নম্বর ওয়ার্ডের রুনু দাস, 20 নম্বর ওয়ার্ডের দুলাল সরকার, 21 নম্বর ওয়ার্ডের চৈতালি ঘোষ সরকার, 22 নম্বর ওয়ার্ডের নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি, 26 নম্বর ওয়ার্ডের অঞ্জু তিওয়ারি ও 29 নম্বর ওয়ার্ডের সুনিতা সরকার ।
প্রাক্তন চেয়ারম্যান নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারি বলেন, "আজ আমরা 15 জন কাউন্সিলর বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি । এই চেয়ারম্যানের আমলে আমরা পৌর নাগরিকদের সঠিক পরিষেবা দিতে পারছিলাম না । আগামীতে যাতে আমরা নাগরিকদের সঠিক পরিষেবা দিতে পারি, তার জন্য এই অনাস্থা নিয়ে এসেছি । আমরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছি । রাস্তাঘাট কিংবা নর্দমা সাফাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাতা প্রদানের সমস্যা রয়েছে । এই চেয়ারম্যান কোনও আলোচনা না করেই নিজের সিদ্ধান্তে টাকা খরচ করেন । মাসিক সভা ডাকেন না । পৌর আইন মানেন না । এ সবের বিরুদ্ধেই আজ আমরা তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা নিয়ে এসেছি ।"
নরেন্দ্রবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, নীহারবাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইশুতে প্রাক্তন চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরি সরব হয়েছেন । আজ কৃষ্ণেন্দুবাবুর দেখানো পথেই কি তাঁরা এই অনাস্থা নিয়ে এসেছেন? তাঁর উত্তর, "এতদিন কৃষ্ণেন্দুবাবু যেসব প্রতিবাদ করতেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে তার ব্যাখ্যা করতাম । আমরা আসলে ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বোঝাতাম । আজ আমরা প্রমাণ পেয়েছি, কৃষ্ণেন্দুবাবু যা বলতেন, পুরোটাই সঠিক । তারই পরিণামে আজ 15 জন কাউন্সিলর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছে । আমাদের নেত্রী যাকে ওই চেয়ারে বসাবেন, তাঁকেই আমরা চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নেব ।"
শহরের রাজনীতিতে কৃষ্ণেন্দুবাবুর ঘনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলর প্রসেনজিৎ দাস বলেন, "2015 সালে আমরা তৃণমূলের প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলাম । নীহারবাবু চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে শহরের পরিষেবা শিকেয় উঠেছে । আমরা জনপ্রতিনিধি । গত লোকসভা নির্বাচনে এই পৌর এলাকায় আমাদের প্রার্থী 62 হাজার ভোটে হেরে গেছিলেন । সেদিনই শহরের মানুষ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নিজেদের অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন । উনি কোনও তৃণমূল কাউন্সিলরের এলাকায় কাজ করেননি । তাঁর আমলে কোনও বোর্ড অফ কাউন্সিলরস ও চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিলের মিটিং হয়নি ৷ পৌরসভা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে । তাই আজ তৃণমূলের সমস্ত কাউন্সিলর তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন । আর কিছুদিন পর পৌরসভার নির্বাচন । বর্তমানে একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি শহরে থাবা বসিয়েছে । সেই শক্তিকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা নীহারবাবুর নেই । আমরা নেত্রীর সৈনিক । আমরা দলের সর্বস্তরে জানিয়েই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি ।"
নীহারবাবুর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে জেলাশাসক কৌশিক ভট্টাচার্য জানান, একটা অনাস্থার চিঠি তিনি পেয়েছেন । এর বেশি আর কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় । অন্যদিকে জেলা তৃণমূল সভানেত্রী মৌসম নুর জানিয়েছেন, এই অবস্থার খবর তিনিও পেয়েছেন । আগামী 30 অগাস্ট ইংরেজবাজার পৌরসভার কাউন্সিলরদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে । সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা হবে । দলের অভ্যন্তরে কোনও সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমেই তা মিটিয়ে ফেলা হবে । তবে পৌরসভার এগজ়িকিউটিভ অফিসার চন্দন গুহ জানিয়েছেন, তিনি এখনও অনাস্থার কোনও চিঠি পাননি । চিঠি পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন । এদিকে কলকাতা থেকে নীহারবাবু জানান, তিনি এমন কোনও খবর পাননি । কেউ তাঁকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি । আগামী পরশু তিনি জেলায় ফিরবেন । তারপরেই এনিয়ে কিছু বলতে পারবেন ।
মালদা জেলায় শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা রাজনৈতিক মহলে সর্বজনবিদিত । এমন কী খোদ তৃণমূল নেত্রীও এই জেলায় এসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে ব্যবস্থা নিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন । কৃষ্ণেন্দু-নীহার দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো । মালদা জেলাপরিষদের বোর্ড গঠনে নীহারবাবুর সমর্থন নিতে বাধ্য হয়েছিল শাসকদল । সেই সুযোগ পেয়ে তিনি ইংরেজবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যানের আসন থেকে এক ঝটকায় টেনে নামিয়েছিলেন কৃষ্ণেন্দুবাবুকে । তবে রাজনীতির চাকা, বলা ভালো গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চাকা থেমে যায়নি । আজ সেই বলটা চলে গেছে কৃষ্ণেন্দুবাবুর কোর্টে । এই ইশুতে আগামীতে শাসকদলের অবস্থান কী হবে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কী নির্দেশ দেবে, তা জানতে এখন উদগ্রীব মালদাবাসী ।