মালদা, 13 জুন : কোরোনা ও লকডাউনকে কেন্দ্র করে নাজেহাল মালদা জেলার মৌ-চাষিরা৷ কারণ লকডাউন শিথিল হলেও এখনও পর্যন্ত তাদের চাষ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়নি৷ চাষিদের বক্তব্য, কোরোনা আবহে এবার তারা মাত্র 20 শতাংশ মধু উৎপাদন করতে পেরেছে৷ ক্ষতির পরিমাণ এখনও পর্যন্ত 6 কোটি টাকার বেশি৷ চলতি মরশুম শেষ হলেই ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানতে পারবে তারা৷ চাষিদের বক্তব্যকে সমর্থন করছে মধুচাষিদের কো-অপারেটিভ সোসাইটি৷ লকডাউনে চাষিদের কিছু সমস্যার কথা মেনে নিয়েছে জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগও৷
উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, মালদা জেলায় সব মিলিয়ে প্রায় 10 হাজার মানুষ মৌমাছি প্রতিপালন ও মধু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত৷ এই চাষিদের মূল উৎপাদন হয় লিচুর মরশুমে৷ কারণ অনেকটা জায়গাজুড়ে চাষ হয় লিচুর । তাই মধু উৎপাদনও বেশি হয় । তাছাড়া, মালদার পাশাপাশি অন্যান্য জেলাতেও লিচু চাষ হয় । এমনকী বিহার ও ঝাড়খণ্ডেও লিচুর ভালোরকম চাষ হয় । তাই মধু সংগ্রহ করতে এই লিচুর মরশুমে বাক্স নিয়ে ভিন জেলার পাশাপাশি ভিন রাজ্যেও যান মালদার মধু চাষিরা৷ কিন্তু কোরোনার জেরে এবার তারা ভিন জেলা ও রাজ্যে কোথাও মধু সংগ্রহ করতে যেতে পারেনি ।
লিচুর মরশুম ছাড়া তিলের মরশুমেও মধু উৎপাদন বেশি হয় । আর লিচুর পরই তিলের মরশুম আসে । তবে, মূলত দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেই তিলের চাষ ভালো হয়৷ তাই প্রতি বছর তিলের মরশুমে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যায় মালদার মধু চাষিরা । কিন্তু এবছর লকডাউনের জেরে তারা দক্ষিণবঙ্গে যেতে পারেনি । ফলে তিলের মরশুমেও তারা যথেষ্ট পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে পারেনি ।
মালদার এক মধু চাষি বিশ্বজিৎ মণ্ডল বলেন, "আমাদের মূল চাষ হয় লিচুর মরশুমে৷ এবার লকডাউনের মধ্যে কেউ মৌমাছির বাক্স নিয়ে লিচু বাগানে যেতে পেরেছে৷ কেউ আবার পারেনি৷ বিশেষ করে এবার আমরা হুগলি জেলায় যেতে পারিনি৷ সেখানে মধু ভালো উৎপাদন হয়৷ ভিন জেলা বা রাজ্যের পাশাপাশি আমরা মালদাতেও যে জায়গাগুলিতে লিচু উৎপাদন ভালো হয় সেখানে যেতে পারিনি৷ ফলে মধু উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে৷ এখন মধু উৎপাদনের মরশুম শেষ৷ মৌমাছি বাঁচিয়ে রাখতে তাই আমাদের বাক্সে চিনি দিতে হচ্ছে৷ আবার যতটুকু মধু উৎপাদন হয়েছে তার দামও পাচ্ছি না৷ মালদা জেলায় সরকারি নথিভুক্ত মধু চাষি রয়েছে প্রায় 700 জন৷ এছাড়াও গোটা জেলায় প্রায় 10 হাজার মধু চাষি রয়েছে৷ লকডাউনে যা ক্ষতি হয়েছে তা কীভাবে পূরণ করব জানি না৷ সরকারি সহায়তা না পেলে জেলার 50 শতাংশেরও বেশি মধু চাষি চরম সমস্যায় পড়বে৷ মৌমাছি বাঁচিয়ে রাখাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে৷"
পুরাতন মালদার চর কাদিরপুরের মধু চাষি প্রদীপ মণ্ডল বলেন, "লিচুর মরশুমে আমরা বাক্স থেকে চারবার মধু বের করি৷ এবার মাত্র দু’বার মধু বের করতে পেরেছি৷ তাও সবাই এবার চাষ করতে পারেনি৷ এবার জেলার বাইরেও বাক্স নিয়ে যেতে পারিনি৷ বাক্স লিচু বাগানে রেখে আসলেও গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে বাক্সের কাছে যেতে পারিনি৷ আমরা সাধারণত বাগানে বাক্স বসিয়ে সেখানেই ক্যাম্প করে থাকি৷ কিন্তু এবার কোরোনার আতঙ্কে আমরা যেমন বাইরে থাকতে ভয় পেয়েছি, তেমনই বাইরের লোকজনও আমাদের বাগানে থাকতে দেয়নি৷ বাইক নিয়ে কোনওরকমে বাগানে গিয়ে দু’বার মধু সংগ্রহ করেছি৷ তবে, মধুর দামও এবার ভালো পাইনি৷ এই মরশুমে যে ক্ষতি হল তা কীভাবে পূরণ হবে জানি না৷ সরকারি সহায়তা না পেলে আমরা পথে বসব৷ এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সাহায্য পাইনি৷ রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কিছু সাহায্য করা হোক৷ কারণ, এখন চিনি খাইয়ে মৌমাছি বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ তার অনেক খরচ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সেই খরচ করার উপায় নেই৷"
জেলার মধু চাষিদের স্বার্থে বাম আমলেই তৈরি হয়েছিল মালদা বি কিপিং অ্যান্ড হানি প্রসেসিং ক্লাস্টার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি৷ সোসাইটির সভাপতি সত্যজিৎ মণ্ডল বলেন, "আমাদের সোসাইটি মালদা জেলার মধু চাষিদের একমাত্র সোসাইটি৷ এই সোসাইটিতে নথিভুক্ত মধু চাষির সংখ্যা প্রায় 700৷ এছাড়াও গোটা জেলায় 7 থেকে 10 হাজার মধু চাষি রয়েছে৷ এই চাষিরা শুধু মালদা বা রাজ্যের অন্যান্য জেলা নয়, বিহার, অসম, ঝাড়খণ্ড সহ একাধিক রাজ্যেও মধু উৎপাদন করতে যায়৷ লকডাউনে এবার চাষিরা ভিন জেলা কিংবা ভিন রাজ্যে যেতে পারেনি৷ জেলার কিছু জায়গায় তারা বাক্স রেখেছিল৷ কিন্তু লকডাউনে নানাবিধ সমস্যায় তারা বাক্সের পরিচর্যা করতে পারেনি৷ বাগানে ঠিকমতো যাতায়াত করতে পারেনি৷ রাস্তায় পুলিশের ভয় ছিল৷ বাগানে ক্যাম্প করে থাকতেও পারেনি৷ কারণ, কোরোনার আতঙ্কে ওই এলাকার লোকজন চাষিদের বাগানে থাকতে দেয়নি৷ কোরোনার জন্য এবার আমাদের যা ক্ষতি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না৷ মৌমাছি বাড়িতে রাখা যায় না৷ বছরভর বাক্স বাড়ির বাইরেই রাখতে হয়৷ কারণ, মৌমাছির উৎপাদনও আমাদের কাছে সমান জরুরি৷ তার জন্য চাষিদের বাগানে নিয়ে যেতে হয়৷ এই চাষিদের তো আর বাইক নেই৷ লকডাউনের মধ্যে কিছু মধু উৎপাদন হলেও তার বাজার দর পাওয়া যায়নি৷ আমাদের উৎপাদিত মধুর বেশিরভাগই বিদেশ যায়৷ লকডাউনে রপ্তানি বন্ধ থাকায় সেই ব্যবসায়ীরা মধু কেনেনি৷ সব মিলিয়ে আমাদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে৷ সরকারি সহায়তা ছাড়া আমাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর উপায় নেই৷ তেমন হলে আমাদের বিকল্প পথ খুঁজতে হবে৷ লিচুর পর তিলের মরশুম আসে৷ সেই চাষ মূলত দক্ষিণবঙ্গে হয়৷ এবার আমাদের চাষি তিল খেতেও যেতে পারেননি৷ তাই এখন থেকেই মৌমাছিকে চিনি খাওয়াতে হচ্ছে৷ গত দু’মাস থেকে মৌমাছির বাক্সে চিনি দিচ্ছে তারা৷ আরও ছয়মাস চিনি খাওয়াতে হবে৷ প্রতি বাক্সে বছরে অন্তত 25 কিলো চিনি দিতে হয়৷ এর বিপুল খরচ৷ এই জেলার বেশিরভাগ চাষি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে মধু চাষ করে৷ ঋণ না মেটালে তারা এরপর ব্যাঙ্ক থেকে সাহায্য পাবে না৷ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মধু চাষিদের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন৷ তার কোনও সুবিধে এখনও আমরা পাইনি৷"
মালদা বি কিপিং অ্যান্ড হানি প্রসেসিং ক্লাস্টার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটির ম্যানেজার প্রসেনজিৎ পাহাড়ি বলেন, "লকডাউনে প্রথমে লিচু, পরে কালো জিরে, ধনে ও তিলের মরশুমে মধু চাষ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এই সময়কালে 20 শতাংশও ব্যবসা হয়নি৷ এই চাষের জন্য এই জেলার কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগর-সহ বিভিন্ন জেলার উপর মধু চাষিরা নির্ভর করে৷ লকডাউনে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি৷ সাধারণত প্রতি মরশুমে জেলার মধু চাষিরা 7 হাজার 500 মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করে৷ এবার তার মাত্র 20 শতাংশ মধু উৎপাদন হয়েছে৷ প্রতি মরশুমে প্রায় 8 কোটি টাকার ব্যবসা হয়৷ এবার জেলায় দেড় কোটির ব্যবসাও হয়নি৷ এখন মধু উৎপাদনের মরশুম শেষ৷ অক্টোবর মাসে ফের নতুন মরশুম শুরু হবে৷ কিন্তু কোরোনার প্রভাবে সেই মরশুমেও মধু উৎপাদন ঠিকমতো হবে কি না বলা যাচ্ছে না৷ কোরোনা জেলার মধু চাষিদের অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ ক্ষতি করে দিয়েছে৷ "
মালদার উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু নন্দন বলেন, "মালদা জেলায় প্রায় 10 হাজার মধু চাষি রয়েছে৷ তবে, তাদের সবাই সরকারিভাবে নিবন্ধীকৃত নয়৷ আমদের বিভাগের সঙ্গে সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ সাবট্রপিক্যাল হর্টিকালচার ও নাবার্ড এই নিয়ে কাজ করছে৷ আমরা জেলার সমস্ত মধু চাষিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আনার চেষ্টা করছি৷ তাতে এই চাষিদের আর্থিক সহায়তা-সহ বিভিন্ন কাজে সুবিধা হবে৷ সম্প্রতি কোরোনা আবহে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মধু চাষিদের জন্য আর্থিক প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু সেই প্যাকেজের সুবিধা পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে৷ আমরা জেলার মধু চাষিদের সংগঠিত করে সেই শর্তগুলিই পূরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি৷ লকডাউন চলাকালীন জেলার মধু চাষিদের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ আমরা প্রশাসনের তরফে অবশ্য সেই সমস্যা সঙ্গে সঙ্গে দূর করার চেষ্টা করেছি৷"