মালদা, 30 ডিসেম্বর: তৃণমূল পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বাংলাদেশি ! এমনই বিস্ফোরক অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন পাঁচ গ্রামবাসী ৷ মামলাটি বর্তমানে বিচারপতি অমৃতা সিনহার ডিভিশন বেঞ্চে বিচারাধীন ৷ তবে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যে দু’বার মহকুমাশাসকের দফতরে এই নিয়ে শুনানি হয়েছে ৷ এবার সেই শুনানিতে উঠে এল বিস্ফোরক তথ্য ৷
মালদা হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লকের রশিদাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান লাভলি খাতুন ৷ অভিযোগ, ভুয়ো পিতৃপরিচয় এবং 11 জনের ভুয়ো সাক্ষ্য ব্যবহার করে ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করিয়েছেন তিনি ৷ আদতে তিনি বাংলাদেশি ৷ গ্রামবাসীদের অভিযোগ, যে ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তিনি ৷ সেই মুস্তাফার মেয়েই নন লাভলি খাতুন ৷ এমনকি 11 জন সাক্ষীর বয়ানে যে স্বাক্ষর রয়েছে, তাও জাল ৷
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে জেলার রাজনৈতিক মহলে ৷ যদিও, অভিযুক্ত বাংলাদেশি পঞ্চায়েত প্রধান নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে দাবি করছেন ৷ তবে, তিনি ক্যামেরার সামনে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি ৷
হরিশ্চন্দ্রপুর 1 নম্বর ব্লকের রশিদাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে ৷ অভিযোগ, তিনি ভুয়ো পরিচয়পত্র দেখিয়ে কংগ্রেসের টিকিটে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতেছিলেন ৷ এরপর শিবির বদল করে তৃণমূলে যোগ দেন ৷ আর তার পুরস্কারস্বরূপ পঞ্চায়েত প্রধানের চেয়ারে বসেন লাভলি খাতুন ৷
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার মানুষজন অভিযোগ করছিলেন যে লাভলি খাতুন ভারতীয় নাগরিক নন ৷ তিনি আদপে বাংলাদেশি ৷ তিনি জালিয়াতি করে ভোটার, আধার-সহ এদেশের সমস্ত পরিচয়পত্র হস্তগত করেছেন ৷ এই নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে একাধিক অভিযোগ দায়ের হলেও, কোনও তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ ৷ তাই শেষ পর্যন্ত এলাকার পাঁচ বাসিন্দা বিষয়টি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ৷
অভিযোগ উঠেছে, লাভলি খাতুন যে 11 জনের সাক্ষীর সমর্থনে নিজের প্রয়োজনীয় ভারতীয় শংসাপত্র পেয়েছিলেন, সেই সাক্ষীদের স্বাক্ষরও জাল ৷ তাঁদেরই অন্যতম শালদহ গ্রামের রিয়াজ আলম ৷ তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁর নামে যে বয়ান কোর্টে সাক্ষী হিসেবে পেশ করেছেন, তা নকল ৷ এমনকি বয়ানে থাকা সই জালিয়াতি করা হয়েছে ৷
তাঁর দাবি, "লাভলি খাতুনকে আমরা কোনোদিন গ্রামেই দেখিনি ৷ তাঁর নামও কোনোদিন শুনিনি ৷ তিনি ভারতীয় সুবিধে পেতে আমাদের গ্রামের মুস্তাফাকে নিজের বাবা বানিয়েছেন ৷ অথচ মুস্তফার একটি মেয়ে আর দু’টি ছেলে ৷ লাভলি খাতুন তাঁর কেউ নন ৷ তিনি লাভলিকে চেনেনও না ৷ সেকথা পুরো গ্রাম জানে ৷ সবাই বলছে, লাভলি খাতুন বাংলাদেশি ৷ তবে, সেটা সঠিক কি না, তা প্রশাসন বলতে পারবে ৷’’
রিয়াজ আরও বলেন, ‘‘আমরা শুধু জানি, তিনি আমাদের গ্রামের মেয়ে নন ৷ কোর্টের নোটিশ থেকে জানতে পারি, তিনি আমাদের সাক্ষী হিসাবে পেশ করেছেন ৷ অথচ আমি তাঁর পক্ষে কোনও সাক্ষ্য দিইনি ৷ কোথাও সই করিনি ৷ বিষয়টি বিডিও এবং এসডিও-কে জানিয়েছি ৷ লাভলিরা সবার সই জাল করেছেন ৷ সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আমাদের পরিচয়পত্র কীভাবে পেলেন, সেটাও আমরা কেউ জানি না ৷ আমরা চাই, এর তদন্ত হোক ৷"
আদালতের নির্দেশে দু’বার শুনানি করলেও বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি চাঁচলের মহকুমাশাসক সৌভিক মুখোপাধ্যায় ৷ তিনি সাফ জানান, এই নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না ৷ একই কথা অভিযুক্ত প্রধান লাভলি খাতুনেরও ৷ তাঁর বক্তব্য, "আমি ভারতীয় নাগরিক ৷ সঠিক সময় আদালতে তার প্রমাণ দেব ৷ এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলব না ৷"
তবে, এই ঘটনা নিয়ে জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক ৷ বিজেপির যুব মোর্চার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়ের অভিযোগ, "হরিশ্চন্দ্রপুরে তৃণমূলের প্রধান লাভলি খাতুন নাকি বাংলাদেশি ৷ এর প্রমাণ মিলেছে ৷ আমরা দলের তরফে বারবার বলেছি, তৃণমূল দলটা বাংলাদেশি দুষ্কৃতী, ধান্দাবাজ আর দালালদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ৷ শুধুমাত্র ভোটের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশিদের এদেশে নিয়ে এসেছেন ৷ তাদের ভুয়ো আধার ও রেশন কার্ড করে দিয়েছেন ৷"
এই বিষয়ে তৃণমূলের জেলা মুখপাত্র আশিস কুণ্ডুর প্রতিক্রিয়া, "রশিদাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন ৷ এই নিয়ে আমরা দলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া দেব না ৷ লাভলি খাতুন কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন ৷ স্থানীয় স্তরে কী হয়েছিল, তা আমরা সেই নেতৃত্বের সঙ্গে কথা না-বলে কোনও মন্তব্য করব না ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আর অনুপ্রবেশের বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দেখা উচিত ৷ তারা যদি কোনও কাজ না-করে, তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই ৷ কারণ, নাগরিকত্ব কেন্দ্রীয় সরকার দেয়, রাজ্য নয় ৷ তাই অনুপ্রবেশ কেন হচ্ছে, তার জবাব বিজেপির দেওয়া উচিত ৷"