মালদা, 21 সেপ্টেম্বর : পুরাতন মালদার মঙ্গলবাড়ি ও সাহাপুর অঞ্চল ৷ এই দুই অঞ্চলকে একসঙ্গে বলা হয় তাঁতিপাড়া ৷ একসময় বাংলাক তাঁতশিল্পে রাজত্ব করেছে এই তাঁতিপাড়া ৷ গোটা এলাকায় ছ’শোরও বেশি তাঁত চলত ৷ পুজোর আগে দিনরাত তাঁতের শব্দ পাওয়া যেত ৷ তাঁতশিল্পীদের তখন নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকত না ৷ তাঁত বোনার জন্যই এলাকার নাম হয়েছিল তাঁতিপাড়া ৷ কিন্তু, এখন সব সোনালী অতীত। পুজো এগিয়ে এলেও এখন তাঁতে ঝড় ওঠে না ৷ শোনা যায় না কোনও তাঁতযন্ত্রের শব্দ ৷ শুধু নামটাই বয়ে চলেছে অতীতের স্মৃতি ৷
পুরাতন মালদায় পাশাপাশি দু’টি অঞ্চল মঙ্গলবাড়ি ও সাহাপুর ৷ মঙ্গলবাড়ি এলাকাটি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হলেও সাহাপুর এখনও পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ৷ এই দু’টি অঞ্চলেই একসময় ছিল তাঁতের রমরমা ৷ সেই কারণেই দুই এলাকার নাম হয়েছিল এক, তাঁতিপাড়া ৷ একটি মঙ্গলবাড়ি তাঁতিপাড়া, দ্বিতীয়টি সাহাপুর তাঁতিপাড়া ৷ এই দুই এলাকার তাঁতের শাড়ি পাড়ি দিত রাজ্যের সর্বত্র ৷ সেই সঙ্গে পাশের বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যেও যেত মঙ্গলবাড়ি ও সাহাপুরের তাঁতের শাড়ি ৷ বছর পাঁচেক আগেও পুজোর সময় চরম ব্যস্ত থাকতেন তাঁতশিল্পীরা ৷ কিন্তু, আজ আর সেই দিন নেই ৷ একসময় ছ’শোর বেশি তাঁত চলত তাঁতিপাড়ায় ৷ এখন হাতেগোনা চার-পাঁচটি তাঁত চালু রয়েছে প্রতিটি এলাকায় ৷ যে ক’টি তাঁত এখনও চালু রয়েছে, তাতে আর শাড়ি তৈরি হয় না ৷ সেগুলিতে খাদির মোটা কাপড়ই তৈরি করেন শিল্পীরা ৷ প্রায় সবাই তাঁতি পেশা পরিবর্তন করেছেন ৷ এককালের তাঁত ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে বাম জমানা শেষ হওয়ার পর থেকেই মালদা জেলায় তাঁত শিল্পের অবনমন শুরু হয় ৷ এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তেমন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি ৷ তাছাড়া হাতে তৈরি তাঁতের শাড়ির বাজারও আর আগের মতো নেই ৷ সব মিলিয়েই পুরাতন মালদায় এই শিল্পের ঝাঁপ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷
আরও পড়ুন : Purba Medinipur Flood : টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত একাধিক গ্রাম, প্রায় আশি হাজার বন্যা দুর্গতকে উদ্ধার
একসময় তাঁতের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন ঝাবুলাল দাস ৷ প্রায় 40টি তাঁতের মালিক ছিলেন তিনি ৷ কয়েক বছর আগে তিনি তাঁতের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন ৷ এখন একটি মুদিখানার দোকান করেছেন ৷ সেই দোকানের পাশে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকা তাঁর তাঁতযন্ত্রে এখন ঘুণ ধরেছে ৷ সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া তাঁতযন্ত্রগুলির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “একসময় এসব আমারই ছিল ৷ আমি তাঁতের ব্যবসা করতাম ৷ 1982-2015 সাল পর্যন্ত এই ব্যবসা করেছি ৷ শুধু নিজের তাঁত নয়, দাদনেও আমার কয়েকটি তাঁত চলত ৷ তাঁতের জন্যই এই জায়গার নাম হয়েছিল তাঁতিপাড়া ৷ কিন্তু সেই শিল্প আর নেই বললেই চলে ৷ সারাদিন তাঁত চালিয়ে একজন শ্রমিক যা রোজগার করেন, অন্য জায়গায় কাজ করলে তার থেকে অনেক বেশি মজুরি জোটে ৷ ফলে শ্রমিকরা আর তাঁত চালাতে চান না ৷ তাছাড়া তাঁতশিল্পে বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে কাজ করতে হয় ৷ একা এই ব্যবসা চালানো যায় না ৷ সেই হিসাবে আমাদের টাকা থাকে না ৷ শুধু মঙ্গলবাড়ি তাঁতিপাড়াতেই প্রায় 400’র বেশি তাঁত ছিল ৷ এখন হাতেগোনা 5-6টি তাঁত চলছে ৷ সেখানে শুধু খাদির কাপড়ই তৈরি হয় ৷ শাড়ি আর হয় না ৷ একসময়ের তাঁতশিল্পীদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ ৷ সবাই অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন ৷ আমি একসময় তাঁতের মহাজন ছিলাম ৷ এখন মুদিখানার দোকান করেছি ৷ পেট তো চালাতে হবে ! একসময় আমাদের তৈরি শাড়ি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে বিহারেও যেত ৷ পুজোর আগে কাজ কিছুটা বাড়লেও সারা বছরই কাজ হত ৷ ভাদ্র মাসের পর ব্যবসা অনেক বেড়ে যেত ৷ মূলত পুজো ও নবান্নের সময় আমাদের ব্যবসা ভাল হত ৷ আমরা সরকারি কোনও সাহায্য পাইনি ৷ তবে শুধু এই কারণে নয়, এই ব্যবসায় পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি না জোটার জন্যই এখানকার তাঁতশিল্পের এই অবস্থা ৷’’
আরও পড়ুন : Weather Forecast : আজও রাজ্যজুড়ে বৃষ্টি, পশ্চিমের জেলাগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কতা
আরেক তাঁতশিল্পী আনন্দ দাসও বর্তমানে মুদিখানার দোকান চালান ৷ তাঁর কথায়, “একজন শ্রমিক সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে খুব বেশি হলে তিনটি শাড়ি তৈরি করতে পারেন ৷ এতে তাঁর আয় হত 120-130 টাকা ৷ কিন্তু এখন অন্য কাজে একজন শ্রমিক হেসে খেলে দিনে 400 টাকা মজুরি পান ৷ তাঁত চালিয়ে শ্রমিকরা যদি তাঁদের সংসারই চালাতে না পারেন, তবে তাঁরা কাজ করবেন কেন ! এখন তাঁত শ্রমিকদের বেশিরভাগ নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ৷ বাম জমানার শেষের পর থেকেই আমাদের সমস্যার শুরু ৷ সরকারি কোনও সহায়তাও পাইনি ৷ তাঁত তুলে এখন মুদির দোকান করেছি ৷ অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না ৷ আমার নিজেরই প্রায় 45টি তাঁত ছিল ৷ গোটা তাঁতিপাড়া এলাকায় ছ’শোর বেশি তাঁত চলত ৷ সারা রাজ্যে আমাদের শাড়ি বিক্রি হত ৷ আগে শাড়ির চাহিদাও ভাল ছিল ৷ পুজোর সময় বেশ ভাল কাজ হতো ৷ লাভও ভাল হতো ৷ মালিক ও শ্রমিক, দু’পক্ষই লাভবান হত ৷ কিন্তু, মিলের কমদামি শাড়ি বাজারে আসতেই আমাদের শাড়ির চাহিদা কমতে শুরু করে ৷ এখন হাতে গোনা কয়েকটি তাঁত চলছে ৷ এখানে তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে বললেই চলে ৷’’
আরও পড়ুন : South Eastern Train: বৃষ্টির জেরে দক্ষিণ-পূর্ব শাখার দূরপাল্লার স্পেশাল ট্রেনের সূচি বদল
এই পরিস্থিতিতে এখনও নিজের শিল্পীসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গোকুল বর্মন ৷ 40 বছর ধরে এই কাজ করছেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘25 বছর বয়সে এই কাজ ধরেছি ৷ আজ আমার 65 বছর বয়স হল ৷ আগে ভাল কাজ হত ৷ এখন খুবই খারাপ অবস্থা ৷ শুধু খাদির কাপড় তৈরি করে কোনওরকমে কাজটাকে ধরে রেখেছি ৷ সবসময় কাজ থাকে না ৷ কখনও কাজ করি, আবার কখনও বসে থাকতে হয় ৷ এভাবেই চলছে ৷ আগে পুজোর সময় খুবই ভাল কাজ হত ৷ এই সময় নকশাদার শাড়ি বেশি তৈরি হত ৷ পুজোর আগে আমাদের চরম ব্যস্ত থাকতে হত । লাভও হত বেশ ভাল ৷ এখন নকশাদার শাড়ি আর তৈরি হয় না ৷ তাঁতিপাড়াতে এখন আর তাঁতের শাড়িই তৈরি হয় না ৷ যাঁদের উৎপাদিত শাড়ি রয়েছে, তা ঘরেই পচছে ৷ শাড়ির বাজারই আর নেই ৷ সরকার থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছি বটে, কিন্তু উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে সরকার কোনও উদ্যোগ নেয়নি ৷ এখানে একটি তাঁতের সোসাইটি ছিল ৷ সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজই নেই তো সোসাইটি থেকে কী হবে ? আমার আটটি তাঁত ছিল ৷ সব খুলে রেখেছি ৷ শুধু তিনটি তাঁত চালু আছে ৷ তবে, খাদি বন্ধ হলে এই তিনটিও খুলে ফেলতে হবে ৷’’
আরও পড়ুন : Mimi Chakraborty : জুতো হাতে কাদায় হাঁটলেন অভিনেত্রী সাংসদ, শুনলেন স্থানীয়দের কথা
বর্তমানে গোটা দেশেই কর্মসংস্থানের অভাব ৷ প্রতিনিয়ত বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যা ৷ করোনার থাবায় কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ ৷ কিন্তু, যে শিল্পের এখনও ভবিষ্যৎ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগ কি প্রয়োজনীয় ছিল না ? প্রশ্ন তাঁতিপাড়ার তাঁত মহল্লার ৷