মালদা, 4 জানুয়ারি: সরকারি জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে দেড় কোটি টাকায় ! সেই জমি আবার রেজিস্ট্রিও হয়েছে ৷ জমির বিক্রেতা দক্ষিণ 24 পরগণার বাসিন্দা ৷ ক্রেতার বাড়ি মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর থানায় ৷ তিনি নিজের জমি রেকর্ড করাতে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে গেলে সর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভূতের সন্ধান পান ৷ জানতে পারেন, এই জমির মালিক আর কেউ নয়, রাজ্য সরকারের একটি সংস্থা।
পাশাপাশি দেখা যায়, জমি কেনাবেচায় বিক্রেতার তরফে জমা করা ওয়ারিশ সার্টিফিকেটে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে ৷ এরপরেই ওই জমির রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের কর্মীরা ৷ এই খবর চাউর হতেই শোরগোল পড়েছে হরিশ্চন্দ্রপুরে ৷
ঠিক কী হয়েছে?
হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় রাজ্য সেচ দফতরের অধীনস্ত মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্ট ডিভিশনের প্রায় 13 বিঘা জমি রয়েছে ৷ জমিটি ঘিরেও রাখা হয়েছে ৷ দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকেই 6 বিঘা জমি হরিশ্চন্দ্রপুর থানার কাউয়ামারি গ্রামের সিরাজুল হককে বিক্রি করে দিয়েছেন দক্ষিণ 24 পরগণার বাসিন্দা দীপেন্দ্রকুমার মিশ্র ৷ দেড় কোটি টাকায় এই জমির কেনাবেচা হয় ৷ জমিটি বিক্রির সময় দাখিল করা ওয়ারিশ সার্টিফিকেটে আলিপুর আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর রয়েছে ৷ নথিতে জমিটিকে রায়তি সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে ৷ সেই কাগজ দেখেই হরিশ্চন্দ্রপুরের তুলসিহাটা সাব রেজিস্ট্রার অফিস জমিটি সিরাজুল হকের নামে রেজিস্ট্রি করে দেয় ৷
কোথায় খটকা?
রেজিস্ট্রির পর জমির রেকর্ড পেতে সিরাজুল হরিশ্চন্দ্রপর ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে আবেদন করেন ৷ কিন্তু জমির সমস্ত নথিপত্র খতিয়ে দেখে দফতরের কর্মীদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে ৷ তাঁরা জমির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সরেজমিনে তদন্তে যান ৷ জমি মাপজোক করে চোখ কপালে ওঠে তাঁদের ৷ তাঁরা দেখেন, সবার অলক্ষ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে সরকারি জমি ৷ তৎক্ষণাৎ তাঁরা রেকর্ডের আবেদনপত্র বাতিল করে দেন ৷
হরিশ্চন্দ্রপুর ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের রেভিনিউ অফিসার হিমাংশুকুমার মণ্ডল বলেন, “একটি জমি রেকর্ড করার জন্য আমাদের কাছে দলিল এসেছিল ৷ সেই দলিল পরীক্ষা করার সময় ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দেখে আমাদের সন্দেহ হয় ৷ আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করি ৷ তখনই জানতে পারি, জমিটি সরকারি ৷ আমরা মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্ট ডিভিশনকে চিঠি দিয়েছি ৷ জমিটি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে এসেছি ৷ দেখা যাচ্ছে, যে দাগের জমি বিক্রি হয়েছে, সেটি মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্টেরই ৷ এটা কোনও রায়তি সম্পত্তি নয় ৷ জমিটি বিক্রি করেছেন দীপেন্দ্রকুমার মিশ্র ও মন্মথ মিশ্র ৷ কিনেছেন সেরাজুল হক নামে এক ব্যক্তি ৷ তিনিই জমিটি রেকর্ডের জন্য আমাদের দফতরে আবেদন করেছেন ৷ আমরা যে কোনও জমি রেকর্ডের আগে সমস্ত বিষয় খতিয়ে দেখি ৷ এই জমিটির পরিমাণ ছ’বিঘার সামান্য বেশি ৷ মহানন্দা এমব্যাংকমেন্ট ডিভিশন যদি জমির সমস্ত নথিপত্র জমা করেন, তবে আমরা দফতরের নামেই জমির রেকর্ড করে দেব ৷”
এদিকে তুলসিহাটা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের রেজিস্টার রমজান আলির দাবি, " আমাদের রেকর্ড বলছে, জমিটি আলেয়া ভট্টাচার্যের ৷ ওয়ারিশ সূত্রে তাঁর এই জমিটি অন্য কেউ বিক্রি করেছেন ৷ আলিপুর কোর্টের লোয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরিত সেই ওয়ারিশ সার্টিফিকেট আমাদের কাছে আছে ৷ এর বলে আমরা কোনও জমি রেজিস্ট্রি করতে পারি ৷ এটা মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্টের জমি কি না, সেটা সেটলমেন্ট অফিস বিচার করবে ৷ তারা যদি জমিটিকে মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্টের বলে জানায়, তবে কোনও নথির ভিত্তিতে বলছে, সেটাও তারাই জানাবে ৷ সেক্ষেত্রে জমির দলিল বাতিল হয়ে যাবে ৷”
মহানন্দা হানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্ট ডিভিশনের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার রাকেশ লালার বক্তব্য, “আমরা এসব কিছুই জানতাম না ৷ গতকাল বিকেলে বিএল অ্যান্ড এলআরও বিষয়টি জানিয়েছেন ৷ আজ জমির ভেরিফিকেশন হয়েছে ৷ দেখা গেল, সম্পূর্ণ জমিটিই আমাদের দফতরের ৷ কীভাবে এই জমি বিক্রি হয়ে গেল বুঝতে পারছি না ৷ এবার সরকারি নিয়ম মেনেই সব কাজ করা হবে ৷ পরবর্তীতে কী হবে সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখবে ৷”
জমির ক্রেতা সেরাজুল হক গোটা ঘটনা জেনে অবাক ৷ তিনি বলেন, “আমি কম্পিউটারে পরচা দেখে ওই জমি কিনেছি ৷ সেখানে জমিটি বাগান হিসাবে উল্লেখ রয়েছে ৷ রায়তি সম্পত্তি হিসাবেও উল্লেখ রয়েছে ৷ সব দেখে জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে ৷ সরকারি জমি থাকলে তিনি তখন কেন বিষয়টি বলা হল না ? এখন জমিটিকে মহানন্দা এমব্যাঙ্কমেন্টের সম্পত্তি বলা হচ্ছে ৷ তাদের নামে যদি নথিপত্র থাকে তবে সেটা সামনে আনুক ৷ আমরা এনিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হব ৷ আমাকে লিখিত দিতে হবে জমিটি সরকারি ৷” সম্প্রতি খোদ মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক কর্তাদের সতর্ক করেছিলেন, সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে ৷ তাঁর সেই সতর্কবার্তার পর হরিশ্চন্দ্রপুরের এই ঘটনায় তোলপাড় প্রশাসনিক মহল ৷