মালদা, 6 অগাস্ট : কোরোনা তো রয়েছেই ৷ দোসর হয়েছে বন্যার আতঙ্ক ৷ উত্তরবঙ্গের প্রবল বৃষ্টিতে জলস্তর বেড়েই চলেছে মহানন্দার ৷ বেশ কয়েকদিন আগেই নদী বিপদসীমা ছাড়িয়েছে ৷ আজ মহানন্দার জল বিপদসীমা 21.00 মিটার ছাড়িয়ে 21.67 মিটার উচ্চতায় বইছে ৷ জল ঢুকতে শুরু করেছে মালদা শহরের অসংরক্ষিত এলাকায় ৷ ইংরেজবাজার পৌরসভার সাতটি ওয়ার্ডের নিচু অংশে ঢুকে পড়েছে নদীর জল ৷ ঘরছাড়া হয়েছে শ’ছয়েক পরিবার ৷ অনেকে জলবন্দি বাড়িতেই বসবাস করছে ৷ যারা নিজেদের ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, তারা এখন প্রবল সমস্যায় ৷ কোরোনা আতঙ্কে এখন শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ৷ এদিকে এখনও পর্যন্ত শহরে কোনও স্থায়ী ফ্লাড সেন্টার তৈরি করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ ৷ ফলে গৃহহীন মানুষজন রাস্তাঘাটের ধারে কিংবা কোনও ফাঁকা জায়গায় তাঁবু তৈরি করতে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে ৷ প্রশ্ন উঠেছে, দেড়শো বছরের পুরানো এই পৌরসভা এখনও পর্যন্ত শহরে স্থায়ী কোনও ত্রাণশিবির তৈরি করতে পারল না কেন ? এ-নিয়ে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে CPI(M) ।
মহানন্দা নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মালদা ও পুরাতন মালদা শহর ৷ দুই শহরের অবস্থান নদীর দুই পাশে ৷ ইংরেজবাজার পৌরসভার 8, 9, 12, 13, 14, 20 ও 22 নম্বর ওয়ার্ডে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর মানুষের বসবাস ৷ নদীর অসংরক্ষিত চরেও গজিয়ে উঠেছে বসতি ৷ নদীর জল বেশি বাড়লে কিংবা বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলে এই এলাকাগুলি জলে ডুবে যায় ৷ সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে উঠে আসতে হয় উপরে ৷ শহরে কোনও ফ্লাড সেন্টার না থাকায় তাদের রাস্তার ধারে কিংবা কোনও ফাঁকা জায়গায় তাঁবু টাঙিয়ে বসবাস করতে হয় ৷ জল নামলে তারা আবার নিজেদের ঘরে ফেরে ৷ এবার বর্ষা মরশুমের প্রথম থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে উত্তরবঙ্গে ৷ তার জেরে মহানন্দার জলস্তর অনেকটা বেড়ে গেছে ৷ একমাস আগে থেকেই ঘর ছাড়তে শুরু করেছে নদীপাড়ের মানুষ ৷ দিন দিন সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে ৷ এই পরিস্থিতিতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা দূরের কথা, ঘরছাড়াদের বেশিরভাগই পৌরসভা থেকে কোনও সাহায্য পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে ৷
ঘরে জল ঢুকে যাওয়ায় একমাস ধরে শহরের বাঁধ রোডের পাশে প্লাস্টিক মাথায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন রুশনি মণ্ডল ৷ তিনি বলেন, “একমাসের বেশি আগে ঘরে নদীর জল ঢুকেছিল ৷ সেই সময় স্বামী এখানে ছিল ৷ আমরা এখানে চলে আসি ৷ কিছুদিন আগে স্বামী ও ছেলে বিহার চলে গেছে ৷ এখন তিন মেয়ে আর নাতি নিয়ে আমি একাই তাঁবুতে আছি ৷ পৌরসভা থেকে একজন এসেছিল ৷ শুধু কথা বলে চলে গেছে ৷ থাকার ব্যবস্থা দূরের কথা, পৌরসভা থেকে কোনও সাহায্যই পাইনি ৷ তিনদিন পৌরসভায় গিয়ে ঘুরে এসেছি ৷ নিজে প্লাস্টিক কিনে ঝুপড়ি বানিয়ে রয়েছি ৷”
অস্থায়ী আস্তানায় থাকা ঝুম্পা মহালদার জানান, “স্বামী টোটো চালায় ৷ লকডাউনে তার ব্যবসা প্রায় বন্ধ ৷ বেশিরভাগ দিনই ঘরে বসে থাকছে ৷ নদীর জল ঘরে ঢোকার আগে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছি অনেক ৷ কিন্তু কোরোনার ভয়ে কেউ ঘর ভাড়া দিতে রাজি নয় ৷ তাই ছেলেকে নিয়ে রাস্তার ধারে থাকতে বাধ্য হয়েছি ৷ এখনও পৌরসভা থেকে কোনও সাহায্য পাইনি ৷ ফ্লাড সেন্টার কী জিনিস, জানি না ৷”
এনিয়ে প্রশ্ন করা হলে পৌরসভার প্রশাসক বোর্ডের সদস্য তথা বিদায়ি ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল সরকার বলেন, “শহরে ফ্লাড সেন্টার নির্মাণের জন্য আমরা রাজ্য সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি ৷ নদীর ধারে দু’তিনটি ফ্লাড সেন্টার তৈরি করে যাতে দুর্গতদের রাখা যায় তার জন্যই এই প্রস্তাব ৷ মালদা শহরে দু’ধরনের বন্যা হয় ৷ এখানে নদীর চরে অনেক মানুষ বসবাস করে ৷ এদের কারও রায়তি জমি নেই ৷ এরা মাফিয়াদের টাকা দিয়ে নদীর চরে বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে ৷ তারা কোথাকার বাসিন্দা তাও আমরা জানি না ৷ এরা এখানকার ভোটারও নয় ৷ তবুও আমরা মানবিকতার খাতিরে প্রতিবার তাদের পাশে দাঁড়াই ৷ আর বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে বেশি বৃষ্টি হলে জমা জলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয় ৷ পৌরসভার 8, 9 ও 12 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নদীর জল বাড়লে দুর্গত মানুষজনকে কাছাকাছি মাঠে থাকার ব্যবস্থা করতেন ৷ বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিত ৷ কিন্তু এখন কোরোনার জন্য শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ৷ স্কুলগুলোও এখন খোলা যাচ্ছে না ৷ তাই বানভাসি মানুষ বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী তাঁবু তৈরি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ৷ এই মানুষদের জন্য আমরা 29টি ওয়ার্ডের বিদায়ি কাউন্সিলরদের প্রত্যেককে 25টি করে প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়েছি ৷ তাঁরাই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ত্রিপল বিলি করবেন ৷ সদর মহকুমাশাসক, পৌরসভার দুই ওভারসিয়ার নদীর জল ঢুকে পড়া এলাকাগুলি পরিদর্শন করেছেন ৷ এই পরিস্থিতিতে 12 নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ি কাউন্সিলর ভালো কাজ করেছেন ৷ তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে পৌরসভার একটি বাড়িতে অস্থায়ী ফ্লাড সেন্টার খুলেছেন ৷ আমরা বিষয়টি নিয়ে জেলাশাসকের সঙ্গেও আলোচনা করছি ৷ তবে নদীর পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে ৷ এভাবে জল বাড়তে থাকলে 95 কিংবা 98 সালের মতো ফের শহর ভাসতে পারে ৷”
এই ইশুতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে CPI(M) ৷ দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কৌশিক মিশ্র বলেন, “গত প্রায় 25 বছর ধরে যে দল ইংরেজবাজার পৌরসভা পরিচালনা করছে, তারা পৌর এলাকার মানুষের উন্নয়নে কোনও কাজই করেনি ৷ শুধুমাত্র চুরি ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছে ৷ গোষ্ঠীকোন্দলে জড়িয়েছে ৷ দফায় দফায় চেয়ারম্যান বদল হয়েছে ৷ কিন্তু মানুষের সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি ৷ শহরে প্রচুর সমস্যা রয়েছে ৷ তার মধ্যে অন্যতম ফ্লাড সেন্টার না থাকার সমস্যা ৷ এই পৌরসভার বেশ কিছু ওয়ার্ড নদী তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত ৷ কয়েক হাজার মানুষ মহানন্দার অসংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করে ৷ নদীর জল বাড়লেই তাদের ঘরবাড়ি ডুবে যায় ৷ কিন্তু পৌরসভার পক্ষ থেকে তাদের কোনও সহযোগিতা করা হয় না ৷ দুর্গতরা রাস্তার ধারে অস্থায়ী আস্তানা বেঁধে থাকে ৷ শহরে দূষণ ও রোগব্যধি ছড়ায় ৷ কোরোনায় তাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ ৷ এখনও পর্যন্ত পৌর কর্তৃপক্ষ কোনও ফ্লাড সেন্টার তৈরি করতে না পারায় তারা রাস্তার ধারে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ৷ আমরা এই সেন্টার তৈরি করার জন্য দীর্ঘদিন আগেই দাবি করেছি ৷ অথচ মানুষের প্রয়োজনে ফ্লাড সেন্টার তৈরি না করে তারা সরকারি অর্থে খেলা আর মেলা করতেই ব্যস্ত ৷ আগামীতে আমরা ফের মানুষের এই দাবি তুলে ধরব ৷”