মালদা, 23 অগাস্ট : এগিয়ে আসছে দুর্গাপুজো । বাঙালির আবেগ । তার সঙ্গে অনেক মানুষের বাৎসরিক রুজিরুটি সংস্থানের মূল মরশুম । বিশেষত সমাজের দরিদ্র-সাধারণ মানুষজনের অনেকেই এই উৎসবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বেশ কিছুদিনের অন্ন সংস্থান করে থাকেন । কিন্তু দেশে কোরোনা পরিস্থিতি এবার সেই মানুষদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কবে এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, কেউ জানেন না । এই পরিস্থিতিতে সুদিনের আশায় তাকিয়ে রয়েছেন মালদা জেলার ঢাকবাদকরা ।
প্রতিবছর দুর্গাপুজোয় মালদা জেলার প্রচুর ঢাকবাদক ভিনরাজ্যে ঢাক বাজাতে যান । জেলার 15টি ব্লক থেকেই ঢাকির দল দিল্লি, মুম্বই, জয়পুরের মত বড় শহর কিংবা বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড-সহ বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেয় । দুর্গাপুজোর চারদিন, এবং তারপর লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত তাঁরা ভিনরাজ্যে থাকেন । এই ক'দিনে যা রোজগার হয়, তাতে 6-7 মাস হেসে খেলে পরিবারের দিন গুজরান হয় । এই জেলার ঢাকবাদকদের বেশিরভাগই চর্মকার সম্প্রদায়ের । পূজো পার্বণ ছাড়া অন্য দিনগুলিতে তাঁরা প্রধানত জুতো সেলাই করেন । কিন্তু এবার কোরোনার প্রাদুর্ভাব তাঁদের পুজোর সেই অতিরিক্ত উপার্জন থেকে বিরত করতে চলেছে । দেশে আনলক চলাকালীনও যেভাবে কোরোনার জাল ছড়াচ্ছে, তাতে পুজোর আগে ট্রেন চালু হলেও ভিনরাজ্যে যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে চিন্তায় তাঁরা । তাঁদের পরিবারের লোকজনও এই আবহে ঘরের লোককে বাইরে পাঠাতে রাজি নয় । কথা হচ্ছিল ইংরেজবাজার ব্লকের মানিকপুর গ্রামের ঢাকবাদক চৈতন্য রবিদাসের সঙ্গে । এই গ্রামে প্রায় 70 জন ঢাকবাদক রয়েছেন । পুজো এগিয়ে আসায় ঘর থেকে ঢাক বের করে অনুশীলনও শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা । সবাই একসঙ্গে অনুশীলন অবশ্য করেন না । কারণ, পেটের চিন্তায় অনেককেই সকাল সকাল জুতো সেলাই করতে বেরিয়ে পড়তে হয় ।
সকালে চার-পাঁচ জন মিলে অনুশীলন করছিলেন চৈতন্যবাবু । তিনি বলেন "দুর্গাপুজোর ঢাক বাজানোর অনেক ঝামেলা । দীর্ঘক্ষণ কাঁধে ঢাক রাখতে হয় । পুজো অনুযায়ী ঢাকের বোল পালটাতে হয় । অনুশীলন না করলে পুজোর সময় ঠিকমতো ঢাক বাজাতে পারব না । তবে এবার কোরোনায় দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে ঢাক বাজানোর ডাক পাব কিনা সন্দেহ রয়েছে । আমরা পুজোর সময় মূলত ভিনরাজ্যে ঢাক বাজাতে যাই । এবার লকডাউনের মধ্যে বাইরে যাওয়া যাবে না । বাইরে যেতে না পারায় এবার আমাদের রোজগারও হবে না । বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা পাড়াগাঁয়ে ঘোরাঘুরি করে জুতো সেলাই করি । তাতে আর ক'পয়সা হয় ! পুজোয় ভিনরাজ্যে ঢাক বাজাতে গেলে অন্তত ছয় মাসের খোরাক সংগ্রহ হয়ে যেত । এবার মালদাতেও বোধহয় কাজে জুটবে না । শুনছি, অনেক পুজো কমিটি এবার শুধু ঘট পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ফলে আগের মত তাঁরা একাধিক ঢাক রাখবে না । একটিমাত্র ঢাকেই তাদের কাজ হয়ে যাবে । কাজ না জুটলে সংসার কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় এখন ঘুম আসে না । সরকারি কোনও সহায়তা এখনও পাইনি । পাব কিনা তাও জানি না । লকডাউনের মধ্যে একবারই শুধু 500 টাকা পেয়েছিলাম । সেই টাকায় ক'দিন চলে? সরকার যদি আমাদের কিছু সাহায্য করে, তবে আমরা বাঁচি ।"
একই বক্তব্য গ্রামের আরেক ঢাকবাদক বিমল রবিদাসের । তিনি বলেন, "50-60 বছর ধরে ঢাক বাজাচ্ছি । দুর্গাপুজোর সময় এমন অবস্থায় কখনও পড়তে হয়নি । পুজোর সময় আমরা প্রতি বছর বিদেশে ঢাক বাজাতে যাই । আমি নিজে দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ে ঢাক বাজাই । সেখানে মজুরি ভালো পাওয়া যায় । চারদিন ঢাক বাজিয়ে পরিবারের ছ-সাত মাসের অন্ন সংস্থান হয়ে যায় । এবার আমাদের আর দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ের মত জায়গায় যাওয়া হচ্ছে না । কোরোনা এখনও দেশে ছেয়ে রয়েছে । এই অবস্থায় ওই সমস্ত জায়গায় যাওয়া বিপজ্জনক । এবার উপার্জন ছেড়ে বাড়িতেই বসে থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে । জুতোর কাজ করে এখন সংসার চালানো দায় । তাই ঢাক বাজানো আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । পুজোর আগে লকডাউন পুরোপুরি উঠবে কিনা জানা নেই । কিন্তু লকডাউন উঠে গেলেও এবার বাইরে যাওয়া যাবে না । জীবনের ভয় নিয়ে আমরা কেউই এবার বাইরে যেতে পারব না । লকডাউনের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাইনি । সেই সাহায্য পাব কিনা তাও জানি না ।"
পুজোর আগে লকডাউন উঠে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলেও এবার ঢাকবাদক স্বামীকে ভিনরাজ্যে যেতে দিতে নারাজ লক্ষ্মী রবিদাস । তিনি বলেন, "যদি স্বামী পুজোর সময় ভিনরাজ্যে যেতে না পারে তবে সংসার অসম্ভব কষ্টে চলবে । সে'কথা জানি । বাইরে ঢাক বাজাতে গেলে 6-7 মাসের রোজগার উঠে আসে । পুজোর আগে ট্রেন চালু হলে কিংবা স্বামীকে ভিনরাজ্যে ঢাক বাজাতে ডেকে পাঠানো হলেও এবার তাকে বাইরে যেতে দেব না । কোরোনা আবহে সবার জীবনের ভয় রয়েছে । তাই শুধু আমি নই, এখানকার কোনও ঢাকির স্ত্রী, স্বামীকে বাইরে যেতে দেবে না । কষ্টে সংসার চলে চলুক । জীবনটা তো আগে ৷ বাইরে ঢাক বাজাতে গিয়ে প্রাণটাই যদি চলে যায় তবে কী হবে? কোরোনার জন্য এবার সব শেষ হয়ে গেল ।"
এগিয়ে আসছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব । দুর্গাপুজোর সঙ্গে ঢাকের বোল । যেন একে অন্যের পরিপূরক । ঢাকিরা ঢাকে বোল তুললেই কোমর দুলে ওঠে সাত থেকে সত্তরের । কোরোনা এবার সব রং শুষে নিয়েছে দুই ইদ উৎসবের । দুর্গাপুজোয় কী হবে এখনও অজানা । তবে একথা নিশ্চিত, এবারের পুজো রংহীন হতে চলেছে মালদা জেলার অসংখ্য ঢাকবাদকের ।