মালদা, 15 ডিসেম্বর : ঘুষ খেয়েছেন খোদ জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক । ঘুষের জন্যই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বেনিয়ম করেছিলেন তিনি । এই অভিযোগে সরব হয়েছেন খাসকোল-মিলকি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা (Khaskol Milky Fishery alleges of bribery against Additional District Magistrate in Malda) ।
তাঁদের অভিযোগ, 2018-য় তৎকালীন জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের প্রত্যক্ষ সহায়তায় মোথাবাড়ির একটি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গঙ্গায় জলকর পায় । এর পিছনে মোটা অঙ্কের টাকা কাজ করেছে । এ নিয়ে তারা জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে ওই টেন্ডার বাতিলের আর্জি জানিয়েছেন । কিন্তু তাদের আর্জিতে প্রশাসন কর্ণপাত করেনি বলে অভিযোগ । সরকারকে কোনও রাজস্ব না দিয়ে মোথাবাড়ির ওই মৎস্যজীবী সমিতি বহাল তবিয়তে গঙ্গাপথ জলকরটি ভোগ করছে । এর ফলে অন্তত 500 মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্যরা পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন ।
জেলা প্রশাসনের কাছে দায়ের করা আবেদনে খাসকোল-মিলকি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির তরফে জানানো হয়েছে, 2018 সালের 11 জানুয়ারি সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী জলকরের টেন্ডার ডাকা হয়েছিল । কিন্তু সমিতি সর্বোচ্চ দর দাখিল করলেও জলকরের বরাত তারা পায়নি । সেই সময় টেন্ডারের শর্তাবলী না মেনে তৎকালীন জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক মোথাবাড়ির একটি ধীবর সমিতিকে সেই জলকরের লিজ় পাইয়ে দিয়েছিলেন । 2018-র 10 অক্টোবর সেই ধীবর সমিতি জলকরের রাজস্ব সরকারের ঘরে জমা দিয়েছিল । কিন্তু তারপর থেকে তারা কোনও রাজস্ব সরকারকে না দিয়েই বহাল তবিয়তে গঙ্গাপথ জলকরের ভোগ দখল করে আসছে ।
বিতর্কিত জলকরটির এলাকা নেহাতই কম নয় । মানিকচক ঘাট থেকে ফরাক্কার দক্ষিণ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি । জলকরের দখল নিয়ে মৎস্যজীবী সমিতিগুলির বিবাদও নতুন কিছু নয় । এর আগে এই দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে । কিন্তু জলকরের বরাত নিয়ে সরাসরি প্রশাসনিক কর্তার দিকে ঘুষের অভিযোগ আগে শোনা যায়নি । যদিও এ নিয়ে নীরব জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর ।
খাসকোল-মিলকি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির পক্ষে গোবিন্দ মণ্ডল বলছেন, "জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক এই জলকরের লিজের জন্য নোটিস দিয়েছিলেন । তাতে লেখা ছিল, সকাল 10টা থেকে দুপুর 2টোর মধ্যে টেন্ডার জমা দেওয়া যাবে । 2টোর পর টেন্ডার খোলা হবে । কিন্তু ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের সরকারি আমলা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে সেদিনের পরিবর্তে তিনদিন পর টেন্ডার করেন । টাকার বিনিময়ে তিনি জলকরের লিজ় মোথাবাড়ি ধীবর সমিতিকে পাইয়ে দেন ।"
তিনি জানান, এর ফলে এই সমবায় সমিতির অন্তত 500 জন মৎস্যজীবী গঙ্গায় মাছ ধরতে পারছেন না । তাঁরা এখন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে দিন কাটাচ্ছেন । গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, "আমরা এই জলকরের জন্য ফের টেন্ডারের জন্য আবেদন জানাচ্ছি । এই বিষয়ে প্রশাসনের প্রতিটি মহলে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি । এই ঘটনার পিছনে তৎকালীন জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক এবং দফতরের কিছু কর্মী জড়িত । মোথাবাড়ি ধীবর সমিতি চার বছরে প্রায় 40 লাখ টাকা সরকারি রাজস্ব জমা দেয়নি । আমরা এ নিয়ে এখনও আদালতে যাইনি । তবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছি ।"
আরও পড়ুন : TMC leader‘s selfie with Pistol : সরকারি চেয়ারে বসে পিস্তল হাতে সেলফি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল তৃণমূল নেত্রী
সমিতির চেয়ারম্যান দুঃখু মণ্ডল বলেন, "2017 সালে দু'টি আরএস নম্বরে গঙ্গাপথ জলকরের টেন্ডার হয় । দফতরের আধিকারিকরা লাখ লাখ টাকা ঘুষ খেয়ে আইন না মেনে টেন্ডার করে অন্য সমবায় সমিতিকে সেটা পাইয়ে দেন । চার বছর ধরে ওই সমিতি সরকারের রাজস্ব দিচ্ছে না । দফতরের আধিকারিকদের একাংশের জন্য সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । চার বছরে প্রায় 40 লাখ টাকার জলকরের রাজস্ব বাকি পড়ে রয়েছে । এটা শুধু একটি আরএস নম্বরের। আমরা ফের টেন্ডার করার জন্য দফতরে আবেদন জানিয়েছি । দফতরের তরফে আমাদের লিখিতভাবে নতুন টেন্ডার করার কথা জানানো হলেও তা করা হচ্ছে না । আমরা এ নিয়ে সরকার, মৎস্যমন্ত্রী এবং খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি ।"
সমিতির সম্পাদক সূর্য মণ্ডলের বক্তব্য, "আমরা মাছ ধরেই সংসার চালাই । সরকারি দফতরের একাংশের জন্য আমরা গঙ্গায় মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত । আমাদের সমিতির অন্তত 500 মৎস্যজীবী পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন । তাঁরা এখন শ্রমিকের কাজ করেন । আমি নিজে ভ্যান রিকশা আর টোটো চালিয়ে সংসার প্রতিপালন করছি । ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে । আমরা চাই, ফের স্বচ্ছভাবে গঙ্গাপথ জলকরের টেন্ডার করা হোক । তাহলেই আমাদের জেলেরা ফের পুরোনো পেশায় ফিরে আসতে পারবে ।"
আরও পড়ুন : Panchayat pradhan arrested : সরকারি অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে গ্রেফতার পঞ্চায়েত প্রধান, শুরু রাজনৈতিক তরজা
বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল বর্তমান জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক, অতিরিক্ত জেলাশাসক শম্পা হাজরার সঙ্গে। তিনি এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে কোনও মন্তব্য করতে চাননি । যদিও দফতরের কর্মীদের একাংশ জানিয়েছেন, বকেয়া জলকর নিয়ে ইতিমধ্যে মোথাবাড়ি ধীবর সমিতির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে (Calcutta High Court) মামলা করা হয়েছে । আদালতের নির্দেশে গতকাল ওই সমিতিকে শুনানিতে ডাকা হয়েছিল । জেলা মৎস্য দফতরের সহকারী ডিরেক্টর করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ায় গতকাল সেই শুনানি হয়নি। তবে বকেয়া রাজস্ব উদ্ধার করতে দফতর বদ্ধপরিকর । তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে । যদিও বিষয়টি নিয়ে খাসকোল-মিলকি মৎস্যজীবী সমিতি আদালতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনার কথাই জানাচ্ছেন দফতরের কর্মীদের একাংশ।