মালদা, 22 ফেব্রুয়ারি: সময়ের সঙ্গে বাড়ছে মালদা শহরের জনসংখ্যা ৷ সক্রিয়তা বেড়েছে জমি মাফিয়াদেরও ৷ বেশ কয়েক বছর ধরে মালদা শহর ও সংলগ্ন এলাকার জলাভূমি ভরাট করে দিচ্ছে এই মাফিয়াচক্র ৷ তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে শহরবাসীকে ৷ নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহর চলে যাচ্ছে জলের তলায় ৷ নীচু এলাকাগুলি থেকে সেই জল বেরোতে লেগে যাচ্ছে কয়েক মাস ৷ এই জলা ভরাটের বিরুদ্ধে ইটিভি ভারতেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৷ কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়নি বলে দাবি বাসিন্দাদের ৷
কোটি কোটি টাকায় বিক্রি জলাজমি: শহরবাসীর অভিযোগ, এই চক্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতানেত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ ৷ সে কারণেই সরকারি নথিতে জলাজমির চরিত্র বদল হয়ে যাচ্ছে ৷ সরকারি জলাজমি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে ৷ সেই জমিতে বাড়ি তৈরির জন্য পৌরসভা অনুমোদনও দিচ্ছে ৷ এমনকী সমস্ত পৌর পরিষেবাও পৌঁছে যাচ্ছে জলায় তৈরি প্রতিটি বাড়িতে ৷ প্রশাসন ও পুলিশের তরফে মাঝেমধ্যে লোকদেখানো অভিযান চালানো হয় বটে, কিন্তু ক'দিন যেতে না যেতেই ফের আগের জায়গায় ফিরে যায় জমি মাফিয়ারা ৷
জলাজমি ভরাটের বিরুদ্ধে মামলা পরিবেশবিদের: অভিযোগ, মাঝেমধ্যে এর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন হলেও মাফিয়া, পুলিশ-প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দাদাদের ভয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না ৷ এবার শহরবাসীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পরিবেশবিদ ও আইনজীবী সুভাষ দত্ত (Environmental Activist Subhas Datta) ৷ আজ তিনি মালদায় এসেই জলাজমি ভরাটের ঘটনা সরেজমিনে খতিয়ে দেখেন ৷ জানিয়ে দেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে এ নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দফতরে চিঠি পাঠাচ্ছেন ৷ 15 মার্চের মধ্যে মালদা শহরের জলাজমি ভরাটের বিরুদ্ধে তিনি গ্রিন ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করতে চলেছেন ৷
মালদা শহরকে ঘিরে রয়েছে একাধিক বিল: এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাতরা ও ভাতিয়া বিল ৷ এই দুই বিলই এই শহরের নিকাশি ব্যবস্থার হৃৎপিণ্ড ৷ চাতরা বিলের আয়তন 8.47 বর্গ কিলোমিটার ৷ গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণাপত্র বলছে, 2000 সালের তুলনায় 2018 সালে চাতরা বিল সংলগ্ন এলাকায় বসতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুন হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ 2000 সালে বিল সংলগ্ন এলাকায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল 2.95 বর্গ কিলোমিটার ৷ 2018 সালে সেই আয়তন নেমে এসেছে 1.31 বর্গ কিলোমিটারে ৷
জলাজমির পরিমাণ: 2000 সালে জলাজমির পরিমাণ ছিল 2.26 বর্গ কিলোমিটার ৷ 2018 সালে সেই পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে 1.04 বর্গ কিলোমিটার ৷ এই তথ্যেই প্রমাণিত, মাফিয়ার দল কী গতিতে এই জলাজমি ভরাট করে ফেলছে ৷ তার ফলও মিলতে শুরু করেছে ৷ প্রতি বছর বর্ষায় একাধিকবার জলবন্দি হয়ে পড়ছে শহর ৷ এমনকী 10 বছর আগেও যেসব এলাকায় জল জমত না, সেই এলাকাগুলিও চলে যাচ্ছে জলের নীচে ৷ গত বছর খোদ জেলাশাসকের বাংলোই জলের নীচে চলে গিয়েছিল ৷ তারপর প্রশাসনের তরফে জলা ভরাটের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযানে নামা হয় ৷ জলাভূমিতে বাঁধ দিয়ে যে পুকুরগুলিতে মাছ চাষ চলছিল, সেই পুকুরগুলির বাঁধ কেটে দেওয়া হয় ৷ কিন্তু মাস দুয়েক যেতে না যেতেই সেই আগের ছবিই ফিরে আসে ৷
পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের বক্তব্য: এ নিয়ে শহরের কিছু মানুষ পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ৷ গোটা বিষয়টি নিজের চোখে খতিয়ে দেখতে আজ মালদায় আসেন তিনি ৷ চাতরা বিলের ভরাট হওয়া কিছু অংশ তিনি খতিয়ে দেখেন ৷ তিনি জানান, এভাবে দেখে সব কিছু বোঝা যাবে না ৷ কিন্তু বিল ভরাটের কিছু তথ্য তাঁর কাছে চলে এসেছে ৷ 2015 সালে এই বিলের জমিতে নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ৷ ফের সেটা চালু হয়েছে ৷ পৌরসভাই বা কী করে এই জমিতে বাড়ির প্ল্যান পাশ করছে, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই আইনজীবী ৷
তিনি বলেন, "জলাজমি ভরাট করে তৈরি হওয়া বাড়িতে পানীয় জল, বিদ্যুৎ-সহ সবকিছুই অবৈধভাবে হয়ে যাচ্ছে ৷ এভাবে চলতে থাকলে তো জলা ভরাট রোখা যাবে না ৷ কিছু মানুষের জন্য সব মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে ৷ এটাই মানুষকে বোঝাতে হবে ৷ আমরা কারও বিপক্ষে নই ৷ কিন্তু মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় সেটাও মানতে পারা যাবে না ৷ মালদার কিছু মানুষ এ নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ৷ আরও কয়েকজন যোগাযোগ করবেন বলেছেন ৷ কিছু অসুবিধের জন্য তাঁরা সরাসরি এর মোকাবিলা করতে পারছেন না ৷ তবে আমি এসব নিয়ে ভয় পাই না ৷ আমি ধর্মের ষাঁড় হয়ে গিয়েছি ৷ সবাই বুঝে গিয়েছে, আমাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করলে ভয়ের ব্যাপার আছে ৷ পরিবেশ রক্ষায় এখনও পর্যন্ত 125টির উপর মামলা করেছি ৷ কোনও মামলায় হারিনি ৷"
জলা ভরাট নিয়ে সরকারি দফতরে চিঠি: এরপরেই সুভাষ দত্ত জানান, এই শহরে জলা ভরাট নিয়ে আগামী তিনদিনের মধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দফতরে চিঠি পাঠাচ্ছেন ৷ আগামী 15 মার্চের মধ্যে গ্রিন ট্রাইবুনালে মামলা রুজু করতে চলেছেন তিনি ৷ স্বভাবতই এই মামলা কোন দিকে এগোয় তা জানার অপেক্ষায় মালদা।
আরও পড়ুন: রাজ্যে প্রথম বইবাগান গড়ে তুলল মালদা জেলা গ্রন্থাগার