মালদা, 28 অগস্ট : মালদা জেলার দুই পৌর এলাকার লাইফ লাইন বাঁচাতে অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন । শুরু হয়েছে মহানন্দার পাড়ে পড়ে থাকা আবর্জনা সাফাইয়ের কাজ । রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ পেয়ে নদীর পাড় থেকে দ্রুত আবর্জনা সাফাই করার নির্দেশ জারি করেছেন জেলাশাসক । মালদা শহরের মিশন ঘাট থেকে সেই কাজ শুরু হয়েছে । এর জন্য ইটিভি ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটি, সবুজ মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক তুহিনশুভ্র মণ্ডল । প্রশাসনের এহেন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জেলার নদী বাঁচাও আন্দোলনে জড়িত মানুষজনও । খুশি নদীপাড়ের বাসিন্দারা ।
ইংরেজবাজার ও পুরাতন মালদা পৌর এলাকার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহানন্দা নদী । এই নদীকে কেন্দ্র করেই পত্তন হয়েছিল দুই শহরের । কিন্তু সময় এগোনোর সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে মহানন্দা । সংকুচিত হয়েছে নদীখাত । একসময় যে নদীর জল পান করতেন দুই শহরের মানুষ, এখন সেই জল পান তো দূরের কথা, স্নানেরও অযোগ্য। মহানন্দা বাঁচাতে গ্রিন ট্রাইবুনালে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অমিত স্থালেকর ও বিশেষজ্ঞ সদস্য শৈবাল দাশগুপ্তের বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, শিলিগুড়ি থেকে বিন্নাগুড়ি এলাকায় মহানন্দা দখলমুক্ত করতে হবে । নদীর দূষণ ঠেকানোর পরামর্শের জন্য গঠন করতে হবে বিশেষজ্ঞ কমিটি । দূষিত জল নদীতে ফেলার আগে ট্রিটমেন্ট করতে হবে । মহানন্দা রক্ষায় আরও একাধিক নির্দেশিকা জারি করে গ্রিন ট্রাইবুনাল ।
জাতীয় পরিবেশ আদালতের এই নির্দেশিকা জারির পরেই পরিবেশবিদরা দাবি তোলেন, শুধু শিলিগুড়ি স্ট্রেচ নয়, মালদা দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দার ক্ষেত্রেও একই নির্দেশিকা জারি করা হোক। মালদা জেলাতেও মহানন্দাকে দূষিত নদী হিসাবে ঘোষণা করা হোক । এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের বাসিন্দা, রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটি, সবুজ মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক তুহিনশুভ্র মণ্ডল । তিনি এনিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে চিঠি দেন । তাঁর এই দাবিকে মান্যতা দিয়ে একই দরবার করেন বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রও । জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, 25 অগস্ট পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের তরফে জেলাশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়, দ্রুত মহানন্দার পাড়ে পড়ে থাকা আবর্জনা সাফাই করতে হবে । সেই নির্দেশ পেয়েই নদীর পাড় সাফাইয়ে উদ্যোগ নেয় প্রশাসন । গতকাল থেকে মহানন্দার পাড়ে পড়ে থাকা আবর্জনা সাফাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে ।
আরও পড়ুন, Mahananda River : মালদায় মহানন্দার জল ব্যবহারের অযোগ্য, দূষিত ঘোষণার দাবি রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির
মহানন্দা বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করছে বহু সংগঠন । ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন । তাঁদেরই একজন, বঙ্গীয় ভূগোল মঞ্চের সদস্য কমল রাম বলেন, “মহানন্দার পাড় সাফাইয়ের উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ । নদীকে কেন্দ্র করেই কোনও সভ্যতা গড়ে ওঠে । কিন্তু মানুষের লোভ এবং অসচেতনতা নদীকে নালায় পরিণত করেছে । শহরের বর্জ্য নদীতে মিশছে । মানুষ নিজেদের বাড়ির আবর্জনা নদীতে ফেলছে । মহানন্দার জল পান করা দূরের কথা, স্নানেরও অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । অনেক কারণে প্রশাসনের পক্ষে বছরভর নদী সাফ করে যাওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে না । তবে মহানন্দা বাঁচাতে মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
মহানন্দা বাঁচানোর লড়াইয়ে আরেক যোদ্ধা কমলকৃষ্ণ দাস বলেন, “মহানন্দার স্বাস্থ্য ফেরাতে প্রশাসনের উদ্যোগকে দু’হাত তুলে অভিনন্দন জানাচ্ছি । কিন্তু নদীর পাড় সাফ করেই নদীকে বাঁচানো যাবে না । মহানন্দাকে বাঁচাতে হলে কিছু দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা অবশ্যই নিতে হবে । শহরের জন্য দ্রুত ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে । শহরবাসীকে আরও সচেতন করতে হবে । তার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রচার চালাতে হবে । বিভিন্ন সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে । এসব না করলে মহানন্দা বাঁচবে না । মনে রাখতে হবে, এই নদী আমাদের মা ।”
নদীপাড়ের বাসিন্দারা মহানন্দার দূষণের জন্য তথাকথিত ভদ্রলোকদেরই দায়ী করেছেন । তাঁদের একজন গায়েত্রী কর্মকার বলেন, “গতকাল থেকে নদীর পাড় সাফাই করা হচ্ছে । খুব ভাল বিষয় । নদী পরিষ্কার থাকলে যেমন দেখতে ভাল লাগে, তেমনই স্নান করতেও ভাল লাগে । আমরা নদীর জলই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করি । বাইরের লোকজন নদীতে আবর্জনা ফেলে যায় । বাধা দিলে তারা নানা কথা বলে । আমাদের হুমকি দেয় । আমরা চাই, নদীকে সবসময় পরিষ্কার রাখা হোক ।”
আরও পড়ুন, কেমন আছে মালদার প্রকৃতি ?
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মায়া সরকার বলেন, “প্রশাসন নদীর পাড় সাফ করছে, আর বাইরের লোকজন এসে নদীতে আবর্জনা ফেলছে । বারণ করলেও শোনে না । উল্টে আমাদের গালমন্দ করে । আগে এই নদীর জলই খেতাম । এখন আর খাই না । তবে গৃহস্থালীর বাকি কাজ নদীর জলেই করি । আমরা চাই, নদী পরিষ্কার থাকুক । সারা বছর নদীকে পরিষ্কার রাখা হলে আমরাও ভাল থাকব ।”
প্রশাসনের এহেন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তুহিনবাবু । এর জন্য ইটিভি ভারতেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি । তিনি বলেন, “সম্প্রতি মালদার মিশন ঘাটে মহানন্দার চেহারা দেখে খুব খারাপ লেগেছিল । নদীর ওই অংশে দূষণ সর্বগ্রাসী ছিল । এরপর আমরা রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির তরফে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল সহ মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাই । অবশেষে মিশন ঘাটে মহানন্দার দূষণমুক্তির কাজে প্রশাসন হাত দিয়েছে জেনে ভাল লাগছে । এর জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ সহ মালদার জেলাশাসক ও জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি । এর জন্য আমি ইটিভি ভারতকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি । কারণ, মালদায় মহানন্দা বাঁচাতে ইটিভি ভারতও দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে । শুধু শিলিগুড়ি স্ট্রেচ নয়, মালদার মহানন্দার অংশও যাতে রাজ্যের দূষিত নদীর তালিকায় আসে, তারও দাবি জানিয়েছি আমরা ।”