মালদা, 31 জুলাই : বাবা ভাড়া করে বাংলাদেশিরা হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় নাগরিক । ভিনদেশিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার এক নয়া চক্র গজিয়ে উঠেছে মালদা জেলার ইন্দো-বাংলা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে । এই বিষয়ে বামনগোলা ব্লকের নালাগোলা গ্রামের এক বৃদ্ধ জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন । অভিযোগপত্রের একটি প্রতিলিপিও জমা দিয়েছেন পুলিশ সুপারের কাছে । তবে এই চক্রের ভয়ে ক্যামেরার সামনে মুখ খুলতে রাজি নন নালাগোলার বাসিন্দারা । যদিও তাঁরা এই চক্রীদের কৌশলের পুরো বিষয়টাই জানিয়েছেন ETV ভারতকে ।
নালাগোলা উত্তর বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা নিতাই দাস । বয়স আশি ছুঁই ছুঁই । পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানা ও উপজেলার অন্তর্গত তিন নম্বর ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের 6 নম্বর ওয়ার্ডের বরদাম এলাকায় । তাঁর দাবি, 1963 সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসেন । তারপর আর কখনও সেদেশে যাননি । প্রথমে কোচবিহারে থাকতেন । পেশায় ছিলেন ভ্যানচালক । সেখান থেকে তিনি স্ত্রী রেণুবালা দাস ও সন্তানদের নিয়ে মালদায় চলে আসেন ।
তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এলেও ওপারেই নিজের পরিবার নিয়ে থেকে যান তাঁর দাদা গৌরপদ দাস । সেখানে তাঁদের পৈতৃক 304 ডেসিমেল জমি আছে । সেই জমির অর্ধেক প্রাপ্য নিতাইবাবুর । কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর তাঁর দুই ভাইপো সেই জমি বিক্রি করে দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে । 2003 সালে দুই ভাইপো সপরিবারে এদেশে চলে আসেন । তখনও তাঁদের নাম বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় ছিল । 2004-এ ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গৌরপদ দাসের পরিবারকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে শংসাপত্র দেন । কিন্তু এক অদ্ভুত উপায়ে তাঁর ভাইপোরা ধীরে ধীরে ভারতের নাগরিক হয়ে যায় ।
নিতাইবাবু বলেন, "বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে আমি 30 বছর কোচবিহারে ছিলাম । নালাগোলাতেও 30 বছর আছি । আমার দুই ভাইপো এখন নালাগোলার গন্ধপাড়ায় থাকে । 2003 সালে তারা সপরিবারে এদেশে আসে । ওরা ফুটপাতের এক লোককে টাকাপয়সা দিয়ে বাবা সাজায় ৷ তারপর ওই লোকের ভোটার কার্ড পেশ করে নিজেদের তাঁর সন্তান হিসেবে দেখায় । পরে ভোটার কার্ড সংশোধন করে তারা পাকাপাকিভাবে এদেশের নাগরিক হয়ে গেছে । এর বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েছি । এবার ফের জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জানালাম । বেআইনিভাবে ভোটার, আধার ও রেশন কার্ড তৈরি করার জন্য আমি তাদের সাজা চাই । এরাই দেশটাকে নষ্ট করছে । ওরা গোরু, মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের চোরাকারবারি করে । ওদের বাড়িতে বাংলাদেশিদের আনাগোনা লেগেই থাকে । আমি চাই প্রশাসন যথাযথ তদন্ত করে তাদের ফের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাক ।"
বাংলাদেশিদের ভারতীয় বাবা ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল নালাগোলার বাসিন্দাদের কাছে । কিন্তু ভয়েতে কেউ ক্যামেরার সামনে মুখ খুলতে নারাজ । এমন কী, মুখ ঢেকেও তাঁরা কেউ ক্যামেরায় বক্তব্য রাখতে রাজি হননি । তবে, কীভাবে এই চক্র কাজ করে তা জানিয়েছে এলাকার মানুষ । তাঁরা জানান, বাংলাদেশের কোনও নাগরিক প্রথমে এদেশে বসবাসকারী কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে আসে । তারপর যোগাযোগ করে বাংলাদেশি থেকে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার মতো বেআইনি কাজের যুক্ত লোকজনের সঙ্গে । এরপর চক্রের লোকজন এলাকায় একই পদবীর কোনও বয়স্ক লোকের খোঁজ শুরু করে । তারা সেই বয়স্ক লোকের ভোটার কার্ডকে ঢাল করে বাংলাদেশিদের ভোটার কার্ডের জন্য ব্লক অফিসে নির্দিষ্ট ফর্ম জমা দেয় ।
সাধারণত ব্লক অফিসে ভোটার কার্ড তৈরিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ নেন সেখানকার কর্মীরাই । চক্রের লোকজন টাকা দিয়ে সেই কর্মীদের হাত করে । তারা বাংলাদেশিদের ফর্মে নো-অবজেকশন লিখে তা পাঠিয়ে দেয় জেলায় । এরপর স্বাভাবিকভাবেই ভোটার কার্ড তৈরি হয়ে যায় বাংলাদেশিদের । এখানেই শেষ নয় ৷ এরপর তারা অপেক্ষা করে এক বছর । এক বছর হয়ে গেলে তারা ভোটার তালিকা সংশোধনের ফর্মে বাবার নাম ভুল রয়েছে জানিয়ে ফের প্রশাসনের কাছে আবেদন জানায় । ব্লক প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মীদের তৎপরতায় সহজেই ভোটার কার্ড সংশোধন হয়ে যায় । তারপরই বাংলাদেশিরা হয়ে যায় পুরোদস্তুর ভারতীয় নাগরিক । স্থানীয়দের দাবি , কিছুদিন ধরেই বামনগোলা এলাকায় এই চক্র সক্রিয় রয়েছে । এই চক্রের লোকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী । প্রয়োজনে এরা মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না ।
গোটা ঘটনাটি জানানো হয়েছিল জেলাশাসক কৌশিক ভট্টাচার্যকে । সব শুনে তিনি বলেন, "এটা ভীষণ গুরুতর অভিযোগ । ওই বৃদ্ধের অভিযোগপত্র আমরা খতিয়ে দেখছি । তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার তদন্ত করা হবে । যারা দোষী প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।"