মালদা, 5 জানুয়ারি: তৃণমূল নেতা দুলাল সরকারের খুনের ঘটনায় এবার দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কার্যত লুক আউট নোটিশ জারি করল মালদা জেলা পুলিশ ৷ দুই অভিযুক্তের নাম কৃষ্ণ যাদব ওরফে রোহন এবং বাবলু যাদব ৷ এই দু'জনকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি ৷ তাঁদের প্রত্যেকের সন্ধানের জন্য দু'লাখ টাকা করে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে ৷
তৃণমূল নেতা খুনের চক্রান্তে আটজন জড়িত ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে ৷ তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত সাতজনের নাম সামনে এসেছে ৷ আরেক জনের নাম এখনও সামনে আসেনি ৷ এদিকে, নিহত দুলাল সরকারের স্ত্রী ইংরেজবাজার পুরসভার 20 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৈতালি ঘোষ সরকার রবিবার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দু'দিনের মধ্যে অভিযুক্তরা সবাই ধরা না পড়লে কিংবা এই চক্রের মাথাকে সামনে না আনা হলে, তিনি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হবেন ৷
ইতিহাস বলছে, যে কোনও ষড়যন্ত্র শুরু হয় ঘর থেকেই ৷ মহাভারত থেকে সিরাজদৌল্লা, তার উদাহরণ মিলেছে ৷ একই উদাহরণ দুলাল সরকারের ক্ষেত্রেও ৷ এই মুহূর্তে যে দু'জনকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে, দু'জনই ছিল বাবলা সরকারের অনুগামী ৷ তেমনটাই জানাচ্ছেন স্থানীয়রা ৷
গত পুর নির্বাচনেও এই দু'জন দুলালের হয়ে কাজ করেছিলেন ৷ 30 বছর বয়সি কৃষ্ণ যাদব ওরফে রোহন ঝলঝলিয়া রেলওয়ে ব্যারাক কলোনির একটি ঝুপড়িতে থাকেন ৷ তবে তিন মাস ধরে তিনি তাঁর দিদার পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকতেন ৷ সেখানেই তিনি বিহারের দুই শার্প শ্যুটারকে এনে রেখেছিলেন ৷ পুলিশি জেরায় রোহনের ভাই, ধৃত অমিত রজক সেকথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর ৷
অন্যদিকে 31 বছর বয়সি বাবলু যাদবের বাড়ি মহানন্দা কলোনিতে ৷ বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী ৷ মা, স্ত্রী ও 10 বছরের মেয়ে রয়েছে তাঁর ৷ নিজে কাজকর্ম কিছু না করলেও মদ্যপানের নেশা ছিল বাবলুর ৷ তাঁর স্ত্রী কখনও টিউশন পড়িয়ে, কখনও বিউটি পার্লারে কাজ করে সংসার টানেন ৷ ঘটনার দিন থেকেই এই দু'জন নিখোঁজ ৷
ঘটনার পর কেটে গিয়েছে 72 ঘণ্টারও বেশি সময় ৷ এখনও পর্যন্ত দুলাল খুনে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ৷ জানা যাচ্ছে, এদিন রাত থেকেই ধৃতদের নিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানোর চেষ্টা করবে পুলিশ ৷ পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদবও সেকথা জানিয়েছেন ৷ তিনি বলেন, "এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ দুই অভিযুক্তের খোঁজে তল্লাশি চলছে ৷ তাদের খোঁজ পেতে পুলিশের তরফে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে ৷"
বাবলু যাদবের স্ত্রী সোনুর কথায়, "বাবলাদাকে খুনের পিছনে যে ও জড়িত, সেটা শুনে আমি স্তম্ভিত ৷ তবে দু'আড়াই বছর ধরে এক বাড়িতে থাকলেও ওর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না ৷ মেয়েকে নিয়েই থাকতাম ৷ আমাদের ডিভোর্স কেসও চলছে ৷ 12 বছর ধরে ও কিছুই করত না ৷ বিয়ের সময় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ৷ শুধরোয়নি ৷"
তাঁর সংযোজন, "বাবলাদা খুব ভালো মানুষ ছিলেন ৷ আমাকে খুব সাহায্য করেছেন ৷ তবে বাবলু বাবলাদার মিটিং-মিছিলে যেত ৷ 1 তারিখ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর বাড়ি ফিরে আসেনি ৷ 2 তারিখ পুলিশ এসে সব জানায় ৷ তখন থেকে আমি পুলিশকে সবরকম সহযোগিতা করছি ৷ ওর খোঁজ পেলে আমি নিজেই পুলিশকে ধরিয়ে দেব ৷ কৃষ্ণ আমাদের বাড়িতে আসত ৷ ওকে এখানে দেখেছি ৷ তবে বিহারের কাউকে বাড়িতে দেখতে পাইনি ৷"
এদিন নিহত তৃণমূল নেতা দুলাল সরকারের স্ত্রী চৈতালি বলেন, "এই বাবলু কিংবা রোহনদের সামনে নিয়ে এসে যেন আসল অপরাধীদের আড়াল না করা হয় ৷ বাবলু যাদবকে এই মুহূর্তে চিনতে পারছি না ৷ এলাকার লোক হলে সে এখানে আসতেই পারে ৷ কিন্তু কে ওকে ব্যবহার করল, সেটা বুঝতে পারছি না ৷ যা করবে পুলিশ করবে ৷ আমি সমস্ত কিছু দলকে জানিয়েছি ৷ আমার দাবি, দু'একদিনের মধ্যে আসল মাথাগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হোক ৷ কোনও প্রলোভন বা চাপের কাছে পুলিশ যেন মাথা না নোওয়ায় ৷ যেভাবে ওকে মারা হয়েছে, তা সাধারণ ঘটনা নয় ৷"
তিনি আরও বলেন, স্বামীর শেষকৃত্যের কাজ শেষ হলেই আমি দিদির (মমতা বন্দ্যোাপাধ্যায়) সঙ্গে দেখা করব ৷ আমার সন্দেহ, কী মনে করছি, সব তাঁকে জানাব ৷ আমি এখনও কোনও হিসাব মেলাতে পারছি না ৷ কেন এই খুন, জানি না ৷"
তবে এদিন একটি বড় আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন দুলাল সরকারের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা, ইংরেজবাজার পুরসভার 26 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গৌতম দাস ৷ তাঁর কথায়, "ধৃত অমিত রজক ও তাঁর সঙ্গীরা দিন পনেরো আগেও এলাকায় শ্যুটআউট করেছিল ৷ সেই ঘটনার তদন্ত ধামাচাপা পড়ে রয়েছে ৷ এদের কে আগ্নেয়াস্ত্র আর টাকা দিচ্ছে, সেটা পুলিশের খুঁজে বের করা উচিত ৷ বাইরে থেকে শার্প শ্যুটার না আসলে এই ঘটনা ঘটত না ৷"
তিনি বলেন, "এই ঘটনায় বিশাল অংকের টাকা লেনদেন হয়েছে ৷ এর মাথাটাকে খুঁজে বের করতেই হবে ৷ পুলিশকে একটু সময় অবশ্যই দিতে হবে ৷ তবে রোহন আর বাবলুকে দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে ৷ নইলে তাদের খুন করা হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি ৷ কারণ, যে বা যারা মূল অপরাধী, তারা প্রমাণ লোপাটের জন্য এই দু'জনকে খুন করার চেষ্টা করবেই ৷"