মালদা, 20 নভেম্বর : কীভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সুজাপুর ৷ তবে কি প্লাস্টিকের টুকরো করার মেশিনে কোনওভাবে বিস্ফোরক পদার্থ ঢুকে পড়েছিল? সেটা সম্ভব নয় বলেই মনে করছে এলাকার অন্যান্য প্লাস্টিক কারখানার মালিক ও শ্রমিকপক্ষ ৷ তেমন অনুমান পুলিশেরও ৷ কারণ, বিস্ফোরক থাকলে সেক্ষেত্রে তার গন্ধ এবং চিহ্ন অবশ্যই পাওয়া যেত ৷ সব প্রশ্নের উত্তর পেতে এখন ফরেনসিক তদন্তের দিকে তাকিয়ে সবাই ৷ তবে গতকালের দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গেছে কালিয়াচক এলাকায় থাকা প্রায় 250 টি প্লাস্টিক ইউনিট ৷ তার মধ্যে অন্তত 50 টি ইউনিটে স্ক্র্যাপ কাটিং মেশিন রয়েছে ৷ ঠিক যে মেশিনে গতকাল বিস্ফোরণ হয়েছে, আজ ওই মেশিন থাকা কোনও কারখানায় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না ৷ মালিকদের মধ্যেও দেখা গেছে আতঙ্ক ৷ এরই মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, এলাকার অনেক কারখানারই নাকি বৈধ অনুমতি নেই ৷ যদিও গতকাল যে কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে, তার সরকারি অনুমতি রয়েছে বলে দাবি করেছেন প্লাস্টিক ইউনিয়নের সম্পাদক ও স্থানীয় বিধায়ক ৷
গতকাল কারখানার যে মেশিনে বিস্ফোরণ হয়েছিল সেটি 45 হর্স পাওয়ার মোটরের মাধ্যমে চলে ৷ সাধারণত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করেন, তাঁদের কাছ থেকে এই কারখানার মালিকরা সেসব কিনে নেন ৷ শুধু জেলা নয়, পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক কালিয়াচক এলাকায় আসে ৷ সেখান থেকে বাছাই করে, সাফ করার পর প্লাস্টিক মেশিনে টুকরো করা হয় ৷ এই মেশিনে চার থেকে ছ’টি ব্লেড থাকে ৷ এই ব্লেডগুলি দিয়েই প্লাস্টিককে টুকরো টুকরো করা হয় ৷ পরবর্তীতে সেই টুকরোগুলি মেল্টিং মেশিনে গলিয়ে তা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হয় ৷ গতকাল ওই কারখানাটিতে 15-16 জন শ্রমিক প্লাস্টিক টুকরো করার কাজ করছিলেন ৷ মেশিন মেকানিকদের কথায়, সাধারণত এইসব মেশিনে ভি-বেল্ট ব্যবহার করা হয় ৷ কোনও কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে সেই বেল্ট প্রথমেই সরে যাওয়ার কথা ৷ মোটরে ওভারলোড হলে তার কয়েল পুড়ে যেতে পারে ৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি ৷ বিস্ফোরণের তীব্রতায় গোটা মেশিন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ৷ অসম্ভব ভারি মেশিনের মূল অংশ বেস থেকে উপড়ে অন্তত 15 ফুট দূরে ছিটকে পড়েছে ৷ মেকানিকদের কেউ আগে এমন এমন ঘটনার সাক্ষী থাকেনি ৷ তবে বিদ্যুৎ থেকে কোনও সমস্যা দেখা দিলে এমন হতে পারে কিনা, তা তাদের ভাবাচ্ছে ৷ আরেকটি কারণ হতে পারে, মেশিনে কোনওরকমে অত্যাধুনিক বিস্ফোরক পদার্থ ঢুকে যাওয়া ৷ কিন্তু সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পর বিস্ফোরকের গন্ধ দীর্ঘক্ষণ থাকত ৷ পাওয়া যেত চিহ্নও ৷ কিন্তু এখানে সেসব কিছুই পাওয়া যায়নি ৷
আরও পড়ুন : কান্নার শব্দে ভারী সুজাপুরের বাতাস
গোটা ঘটনায় একইসঙ্গে চিন্তিত ও আতঙ্কিত সুজাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান ও কালিয়াচক প্লাস্টিক ইউনিট ওনার্স ইউনিয়নের সম্পাদক মফিজুল শেখ ৷ গতকালের দুর্ঘটনায় মৃত, কারখানার এক অংশীদার আবু সায়েদ তাঁর নিকটাত্মীয়৷ তিনি বলেন, "এই এলাকায় 50টির বেশি কারখানায় প্লাস্টিক কাটিং মেশিন রয়েছে৷ কালিয়াচক এলাকায় 30 বছরের বেশি সময় ধরে এই ব্যবসা চলছে৷ এতদিন কোনও কারখানায় এমন ঘটনা ঘটেনি ৷ এটি একটি দুর্ঘটনা বলা যায় ৷ গতকালের ঘটনার পর আমাদের মনে হচ্ছে, এই কাজে শ্রমিকদের একটু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে ৷ এতদিন ধরে এখানে এই ব্যবসা চালু থাকলেও এখনও পর্যন্ত সরকারি স্তরে মালিক কিংবা শ্রমিকদের কোনওরকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি ৷ সেই প্রশিক্ষণ থাকলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে ৷ এই ব্যবসার সঙ্গে লাখ দুয়েক মানুষের রুজি রোজগার জড়িত ৷ ফলে এই ব্যবসাকে উপেক্ষা করা যায় না ৷ গতকালের ঘটনার পর আমরা কারখানা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবছি ৷ কারণ, দুর্ঘটনা কাউকে বলে হয় না ৷ যে কোনও সময় হতে পারে ৷ তাই আমরা শ্রমিকদের বিমার আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাচ্ছি ৷ এনিয়ে আমরা ইউনিয়নেও আলোচনায় বসব ৷”
আরও পড়ুন : সুজাপুর বিস্ফোরণে রাজনৈতিক তরজা তুঙ্গে, কংগ্রেসের ক্ষতিপূরণ ঘোষণা ; ঘটনাস্থানে STF
যতদূর জানা গেছে, এই কারখানাগুলির কিছু অংশের পরিবেশ দপ্তর ও দমকল বিভাগের ছাড়পত্র থাকলেও অধিকাংশই শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্সের উপরেই ব্যবসা করে৷ তবে যেসব ইউনিট ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে খুলেছে, সেগুলির বিমা রয়েছে ৷ গতকালের কারখানাটিও ব্যাঙ্কের ঋণে বছর চারেক আগে চালু হয়েছিল ৷ বছরে কালিয়াচকের স্ক্র্যাপ প্লাস্টিক ইউনিটগুলি অন্তত 200 কোটি টাকার ব্যবসা করে৷ এই নিয়ে স্থানীয় বিধায়ক ইশা খান চৌধুরিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিনা বৈধ নথিতে যদি কোনও এমন কারখানা এখানে চালু থাকে তবে সেটা রাজ্য সরকারেরই ভুল ৷ তবে আমি যতদূর জানি, এই ব্যবসা অবৈধ নয় ৷ এই কারখানাগুলির সবকিছু খতিয়ে দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের ৷ তবে গতকাল যে কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার বৈধ অনুমতি রয়েছে ৷”