মালদা, 15 সেপ্টেম্বর : ধর্ম কিংবা শিক্ষা, গঙ্গার তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি কিছুই । রাক্ষুসী নদীর গর্ভে তলিয়ে যেতে বসেছে মন্দির-মসজিদ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । তলিয়ে গিয়েছে 400 বাড়ি ৷ পূণ্যতোয়ার ছোবলে ঘর ছেড়ে পাশাপাশি আশ্রয়ে রাম-রহিম ।
কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের বীরনগর 1 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারটোলা, মহেন্দ্রটোলা, ভীমাগ্রামের মানুষ এখন শঙ্কায় । কখন যে রাক্ষসী ফের চেরা জিভ বের করে সবকিছু তার পেটে ঢুকিয়ে নেবে, কেউ বুঝতে পারছেন না । বিপন্ন মানুষের এখন একটাই আর্তি, তাঁদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করুক প্রশাসন । কিন্তু প্রশাসনের কর্তারা এখনও বিপন্নদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি বলে অভিযোগ । তাই দুর্গতরা নিজেদের দাবি জানাতে পারছেন না । যদিও ব্লক প্রশাসন জানিয়েছে, গোটা ঘটনায় নজর রাখা হয়েছে । প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা হয়েছে ।
গঙ্গার জলস্তর এখন নিম্নমুখী । এই জেলার নদীপাড়ের মানুষ জানেন, নদীর জল বাড়া ও কমার সময় ভাঙন হয় । জল কমার সময় ভাঙনের তীব্রতা থাকে সবচেয়ে বেশি । সেটাই হয়েছে গত রবিবার । 24.30 মিটার উচ্চতায় থেকে গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় পাড়ে ছোবল মেরেছে গঙ্গা । সরকারটোলা ও মহেন্দ্রটোলায় তলিয়ে গিয়েছে প্রায় 400 বাড়ি । এলাকার একমাত্র গার্লস স্কুলের একাংশ নদীর উপর ঝুলছে । যে কোনও মুহূর্তে তিনতলা স্কুলবাড়ি পুরোটাই নদীতে তলিয়ে যেতে পারে । রবিবার সকাল থেকে টানা পাঁচঘণ্টা সরকারটোলায় তাণ্ডব চালানোর পর রাতে ভীমাগ্রামে হামলা চালায় নদী । সেখানেও প্রায় 70টি বাড়ি নদীতে তলিয়ে যায় । পরদিন থেকে দুই এলাকায় ভারি হাতুড়ির শব্দ । বেঁচেবর্তে থাকা নদীপাড়ের বাড়িগুলি ভেঙে ফেলা হচ্ছে । ইট-কাঠ কোথায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তা সবার অজানা । আপাতত অস্থায়ীভাবে অন্য কারওর জায়গায় সেসব রাখা হচ্ছে ।
আরও পড়ুন : গঙ্গা ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা, দুর্গতদের পুনর্বাসনের দাবিতে পথে বামেরা
পাড়ে ছোবল মারার সময় গঙ্গা ধর্ম দেখেনি । তার তাণ্ডবে ভীমাগ্রামের মজসিদের নীচ দিয়ে বইছে নদীর জল । হাটখোলায় থাকা প্রাচীন শিবমন্দির ধ্বংসের প্রহর গুণছে । গঙ্গার ছোবলে এক হয়ে গিয়েছে রাম-রহিম । একে অন্যকে এখন বাঁচার রাস্তা দেখাচ্ছেন । তেমনটাই বলছিলেন ভীমাগ্রাম হাটখোলার বাসিন্দা দীপন মণ্ডল । তিনি বলেন, "আমার 34 বছর বয়স হল । আমার পরিবার অন্তত 70 বছর ধরে এখানে বসবাস করছে । ছোটোবেলায় দেখেছি, দুটো বাঁধ পার করে গঙ্গায় যেতে হয় । বাড়ি থেকে গঙ্গা যেতে 10-15 মিনিট হাঁটতে হত । এবার সেই গঙ্গায় আমাদের বাড়ি পড়ে গেল । ভাঙনে বাড়ির আর অস্তিত্ব নেই । রবিবার রাতে এখানের প্রায় 70টি বাড়ি নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । বীরনগরের অবস্থা আরও খারাপ । সেখানে 400টির বেশি বাড়ি গতকাল তলিয়ে গিয়েছে । আমাদের গ্রামে প্রাচীন শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে এখন গঙ্গা বইছে । গঙ্গা যদি চায়, তবে মন্দির বাঁচবে । নয়তো সেটাও নদীতে তলিয়ে যাবে । গ্রামের মসজিদ গঙ্গার উপর ঝুলছে । গঙ্গা আর ধর্ম দেখেনি । মন্দির-মসজিদ তার কাছে এক । আমরা সরকারি কোনও সহায়তা এখনও পাইনি । সেই সাহায্যের দাবি জানাচ্ছি ।"
সরকারটোলা গ্রামে নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে বীরনগর গার্লস হাইস্কুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন সাফিকুল আলম । যেন হিসাব কষছিলেন, আর কতটা সময় পেরোলে তিনতলা স্কুলবাড়িটা নদীতে আশ্রয় নেবে । তিনি বলেন, "ভাঙনের পরিস্থিতি ভয়াবহ । নদীর পাড়ে গার্লস স্কুল । গঙ্গা সেটাকেও ছাড়েনি । স্কুলের বাথরুম নদীতে পড়ে গিয়েছে । স্কুল থেকে জিনিসপত্র বের করার চেষ্টা চলছে । গতকাল পুলিশ প্রশাসনের তরফে এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক হয়েছে । স্কুলের ওপারে মহেন্দ্রটোলায় অন্তত 400 বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে । অনেকে ঘর থেকে কুটোটুকুও বের করার সময় পাননি । আজও গঙ্গা অল্পবিস্তর পাড় ভাঙছে । এই স্কুল বাঁচানো আর সম্ভব নয় । এভাবে ভাঙন হলে এলাকার বাজারটাই নদীতে চলে যাবে । গতকাল বৈষ্ণবনগর থানার আইসি এলাকায় এলেও আজ কাউকে দেখা যায়নি । এই ভাঙন রোধ করতে হলে সরকারকেই কাজ করতে হবে । বোল্ডার পাইলিং বা প্রোকোপাইন পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে ভাঙন কিছুটা ঠেকানো যেতে পারে ।"
আরও পড়ুন : BSNL : জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিস চত্বরে ধুঁকছে বিএসএনএলের কাস্টমার সার্ভিস সেন্টার
স্থানীয় বাসিন্দা সুফলচন্দ্র মণ্ডল বলেছেন, "ভাঙন রোধের কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের । এখানে গঙ্গার ভাঙন রোধের দায়িত্ব ফরাক্কা ব্যারেজ প্রোজেক্টের । কীভাবে ভাঙন আটকানো যাবে, তারাই বলতে পারবে । কয়েক যুগ ধরে নদী এখানে পাড় কাটছে । নদী নিজের গতিপথ থেকে প্রায় 10 কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে এসেছে । একমাত্র নদীর ধারে কংক্রিটের দেওয়াল তৈরি করা গেলেই নদীর ভাঙন আটকানো যাবে । আমরা চাইছি, যে কোনও উপায়ে ভাঙন আটকানোর ব্যবস্থা করা হোক । গতকাল অন্তত দেড়শো বাড়ি নদীতে তলিয়েছে । পুনর্বাসনের ব্যবস্থা দূরের কথা, বিপন্ন মানুষের জন্য সরকারিভাবে ত্রিপল কিংবা পলিথিনও দেওয়া হয়নি ।"
যে স্কুলে গঙ্গা ছোবল মারতে শুরু করেছে, সেই বীরনগর গার্লস হাইস্কুলেই আশ্রয় নিয়েছে 30টি ভাঙন দুর্গত পরিবার । 2016 সাল থেকেই ওই পরিবারগুলি এখানকার সরকারি শিবিরে রয়েছে । গঙ্গা স্কুল ভবনের একাংশ কেটে নিলেও কেউ শিবির ছাড়তে রাজি নন । সেখানে থাকা শংকর মণ্ডলের গলায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভও শোনা গেল । তিনি বললেন, "পাঁচ বছর ধরে এখানে রয়েছি । প্রশাসনের কোনও সাহায্য পাইনি । সেবার 83 জনের বাড়ি নদী গিলেছিল । তার মধ্যে 18 জন এখনও পুনর্বাসনের জায়গা পাননি । অথচ তাঁদের সরকারি জমির পাট্টা রেকর্ড হয়ে রয়েছে । তার মধ্যে আমিও রয়েছি । বিডিও, বিএল অ্যান্ড এলআরও, সবার কাছে গিয়েছি । জমি না দিলে কোথায় যাব ? তাই এই স্কুলেই এখনও থেকে গিয়েছি । গঙ্গা এখন এই স্কুলও গিলতে শুরু করেছে । কিন্তু আমরা কেউ সরে যাইনি । সেই 2016 সাল থেকে দৌড়ে বেড়াচ্ছি । আর দৌড়াতে পারছি না ।"
এই বিষয়ে কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের বিডিও মামুন আখতার জানিয়েছেন, তিনি সরকারটোলায় ভাঙনের পরিস্থিতি দেখে এসেছেন । বিপন্ন মানুষের তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তৈরি করার কাজ চলছে । ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সমস্ত কিছু জানানো হয়েছে । দুর্গতদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।
আরও পড়ুন : canning ; মানসিক ভারসাম্যহীন দুই সন্তান, কিডনি বিকল গৃহকর্তার ; সরকারি সাহায্যের আর্জি গৃহকত্রীর