শুরুটা হয়েছিল 1984 তে । যাদবপুরে সিপিএমের হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে মমতার সংসদে প্রবেশ । অথচ সেই যাদবপুরেই 1989 তে হারতে হয় তাঁকে । তার পর নিজের 'হোম কনস্টিটুয়েন্সি' দক্ষিণ কলকাতা থেকে প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । শুরু হল এক ধারাবাহিক জয়ের ইতিহাস ।
সাত বারের সাংসদ । তার মধ্যে টানা ছয় বার । এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী । সাংসদ হিসেবে মমতার কৃতিত্ব কী ? অনেক । তালিকা দীর্ঘ । বহু দিনের সাংসদ জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ নানা ঘটনা, পালন করেছেন সরকারি বা বিরোধী পক্ষ থাকাকালীন নানা ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা । সব কিছু মিলিয়ে নিজের মূলত দুটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে চেয়েছেন বার বার । এক, বাংলার স্বার্থে তিনি লড়াই করবেন, এবং দুই, সিপিএমকে তিনি সহ্য করতে পারেন না । এই দুই সত্বা থেকে তৈরি যে ঝাঁঝ, সেটাই মমতাকে দিল্লির দরবারে আরও বেশি পরিচিতি, গুরুত্ব দিয়েছে ।
লোকসভা মমতার আরও একটা ম্যাজিকের সাক্ষী । তা হল নিজের নীতি-বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আপসহীন লড়াই । কখনও সুসময়, কখনও দুঃসময়, আবার অদম্য জেদে ঘুরে দাঁড়ানো । 1984 - মমতা রাজীব গান্ধির স্নেহধন্য । 1991 বা 1996 - মমতা কংগ্রেস সাংসদ । কিন্তু, লড়াই চলছে ভিতরে । সিপিএম বিরোধিতার লাইন ধরে । 1998 থেকে মমতা নিজের তৈরি তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ । 2004 । মমতা একা সাংসদ । সংসদে বলার বেশি সুযোগ পাননি । সিপিএম সাংসদরা দাপিয়েছেন । কিন্তু, নিজের জেদ থেকে কখনও সরে আসেননি মমতা ।
এর পর 2011 । লোকসভা থেকে পদত্যাগ । রাজ্যে পালাবদলের চূড়ান্ত লড়াই । ভবানীপুর থেকে লড়লেন । জিতলেন । ফের এক নতুন লড়াই । পর পর দুই বার এই ভবানীপুর থেকে জয় । বিধায়ক । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ।
1984 থেকে 2021 । প্রায় চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক যাত্রা । কিন্তু, এই প্রথম কোথায় যেন মমতাময়ী ক্যারিশমা চ্যালেঞ্জের সামনে । প্রথম বার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েটকে তিনি হারিয়েছিলেন বটে । কিন্তু, সে দিন তিনি মমতা হননি । রাজীব গান্ধির মহিলা প্রার্থী খোঁজার ইচ্ছাতেই প্রদেশ নেতৃত্ব বেছে নিয়েছিল মধ্য কুড়ির সেই লড়াকু মেয়েটাকে । যুব কংগ্রেস নেত্রী । যাদবপুর তখন লালদুর্গ । চারপাশে উড়ছে লাল আবির । সে দিন হেরে গেলেও মমতার কিছুই হারানোর ছিল না । কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও বোধ হয় সে দিন ভাবতে পারেননি মমতা এতটা সহজে জিতবেন । কিন্তু, জিতেছিলেন ।
আরও পড়ুন : প্রার্থী হতে না পেরে কেঁদে ফেললেন আরাবুল ইসলাম
তার পর অবশ্য ভোটের ময়দানে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয়নি তাঁকে । দিন যত এগিয়েছে, ততই বৃদ্ধি পেয়েছে মমতা-ক্যারিশমা । নিজে জননেত্রী হয়ে উঠেছেন । মমতা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন আর হাজারো-লাখো মানুষ তাঁকে অনুসরণ করেছেন । তাঁকে দেখে এগিয়ে এসেছেন হত দরিদ্র-অবহেলিত মানুষ । নেত্রী মমতা অচিরেই হয়ে উঠেছেন সকলের দিদি । 1998 তে তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পর এই জনসমর্থন আরও বেড়েছে । রাজনীতিকে মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায় নিয়ে যান মমতা ৷ সাংবাদিক থেকে শুরু করে ক্রীড়াজগত ৷ সেখান থেকে টালিগঞ্জের একাধিক মুখকে প্রার্থী করেছেন ৷ লোকসভা, রাজ্যসভা এমনকী বিধানসভায় জিতিয়ে আনেন ৷ দলের একাধিক কর্মকাণ্ডে রূপোলি পর্দার নায়ক নায়িকাদের ঠাঁই দেন ৷ দলের একাধিক অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষকে মঞ্চে তুলে আনেন ৷ যেভাবে আপদে বিপদে মমতাকে ছুটে যেতে দেখা গিয়েছে বারে বারে তাতে অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন জননেত্রী-দিদি-ঘরের মেয়ে ৷
এই দিদি ক্যারিশ্মাকেই কাজে লাগিয়ে বামেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঐতিহাসিক সাফল্য ৷ এগারোর বিধানসভা নির্বাচনে সবুজ আবির ওড়ানোর পর যেভাবে জনসমুদ্রকে সঙ্গে নিয়ে মমতাকে মহাকরণে প্রবেশ করতে দেখা গিয়েছিল, বাংলার রাজনীতিতে সেই দৃশ্য সম্ভবত শেষবার দেখা গিয়েছিল 1977 সালে । সেই বার জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট বাংলার মসনদে আসীন হয় । বরাবরই একটা দিদি সুলভ মানসিকতা থেকে রাজনীতি করেছেন মমতা ৷ সমর্থন তাঁর পক্ষে এতটাই তীব্র হয়েছে যে বিরোধীদের পর্যদুস্ত করতে তাঁকে দু'বার ভাবতে হয়নি ৷ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারানো যদি মমতা জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন হয়ে থাকে তাহলে এগারোয় মহাকরণ প্রবেশ নিঃসন্দেহে আরও এক মাইলফলক ।
পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টেছে ৷ 34 বছরের পর বামেদের পতন কার্যত দেওয়াল লিখনে পরিণত হয়েছিল ৷ এগারোর আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বেশ কিছু মন্তব্য, দলের বেশ কিছু হটকারী পদক্ষেপ, একাধিক বাম নেতার আলটপকা কথা তাদের প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে দিয়েছিল ৷ সেই সময় বিকল্প খুঁজছিলেন মানুষ ৷ বিকল্প হিসেবে ছিলেন একমাত্র মমতা -- তাঁর জয়ও কার্যত নিশ্চিত ছিল ৷ কিন্তু 2021-এ পরিস্থিতি অনেকটাই অন্য ৷ যে নন্দীগ্রাম, যে অধিকারী-পরিবার মমতার হাত শক্ত করেছিল, সেই অধিকারী-পরিবার আজ মমতা বিরোধী ৷ মেদিনীপুরের যে মাটি থেকে পরিবর্তনের বিজয়কেতন ওড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন মমতা, সেই মাটি থেকেই মমতা বিরোধিতার সুর সপ্তমে তুলেছেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ যে শুভেন্দু এক সময় তৃণমূলের প্রায় দ্বিতীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, সরকার এবং দলের একাধিক পদ সামলেছিলেন, সেই শুভেন্দু আজ মমতার সব থেকে বড় বিরোধী ৷ পরিস্থিতি এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে নিজের গড় ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হতে হল মমতাকে ৷ ঘোষণা করতে হয়েছে নন্দীগ্রাম তাঁর অন্যতম পয়া ভূমি ৷ নন্দীগ্রাম মমতাকে অগ্নিকন্যা বানিয়েছে ৷ সেই নন্দীগ্রাম থেকে এবার দলকে বাঁচানোর মরণপণ লড়াই শুরু করলেন তিনি ৷
আরও পড়ুন : খেলব-লড়ব-জিতব স্লোগান তুলে কথা রাখতে নন্দীগ্রাম চললেন মমতা
রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন মেদিনীপুরের পরিস্থিতি এখন এতটাই জটিল এবং সেখানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র যে অন্য কাউকে প্রার্থী করার কথা ভাবতেই পারছে না দল ৷ শুভেন্দু অধিকারীর পরবর্তী অখিল গিরি, সৌমেন মহাপাত্রদের নন্দীগ্রামে আনার ঝুঁকি নেননি নেত্রী ৷ যাতে কোনওভাবেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্র না হয় ৷ কোনও ভাবে কেউ অসন্তুষ্ট না হন সেজন্য আগেভাগেই নন্দীগ্রামে প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন ৷ খুব সম্ভবত মমতার 40 বছরের বেশি রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথমবার এত বড় চ্যালেঞ্জের সামনে তিনি ৷
2011 বিধানসভা নির্বাচন । জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশ্মার কাছে থমকে গিয়েছিল বামেরা । 34 বছরের বাম দুর্গের পতন ঘটেছিল । শুরু হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতার পথ চলা । এগারোর বিপর্যয়ের পর আর সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বামেরা । ষোলোর নির্বাচনে আরও পিছিয়ে পড়ে । একুশের নির্বাচন যখন ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে, তখনও কোনও মুখ তুলে আনতে পারছে না বামেরা । যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় 40 বছর ধরে বঙ্গ-বঙ্গের সীমা ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতির অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন, তিনি আজ ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে । যেভাবে আজ থেকে দশ বছর আগে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে বামেরা । সেদিন বামেদের চ্যালেঞ্জ জানানো মমতাকে আজ চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে গেরুয়া ব্রিগেড, যাঁরা রকেট গতিতে বাংলার মাটিতে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে চলেছে ।
আরও পড়ুন : মহিলাদের সুরক্ষিত রাখতে ফেমাস ক্য়ান্ডিডেট রত্না; কেন বললেন মমতা?
মমতার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক কঠিন ।
কারণ ৷ এক ) এই বয়সে হারের স্বাদ নিশ্চয় তিনি নিতে চাইবেন না ৷ দুই ) 2026-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স সত্তরের কোঠায় পৌঁছাবে ৷ সেই বয়সে আর কতটা তিনি বিধানসভা নির্বাচনের ধকল নিতে পারবেন সন্দেহ আছে ৷ তিন) নন্দীগ্রামে যিনি মমতাকে হারাবেন তিনি পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসবেন ৷ চার ) তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মুখ নিঃসন্দেহে মমতা ৷ দল বিপুল সাফল্য পেলেও তিনি যদি হেরে যান তাহলে বিরোধী মনোবল বহুগুণ চাঙ্গা হবে ৷ পাঁচ ) এই নন্দীগ্রাম থেকেই এগারোয় নতুন সূর্য ওঠার ডাক দিয়েছিলেন ৷ যদি মমতা হেরে যান তাহলে ফের এক নতুন সূর্য উঠবে নন্দীগ্রামের মাটি থেকে ৷ সন্দেহ নেই মমতার পরাজয় মানে শুধু তাঁর নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যত সমাধি রচনা ৷ নিজের হাতে তৈরি দলের এ হেন পরিণতি তার জীবদ্দশায় নিশ্চয় দেখতে চাইবেন না নেত্রী ৷ অর্থাৎ, শুধু নিজের সম্মান, অস্তিত্ব, জনমোহিনী গ্ল্যামার রক্ষাই নয়, দলকে বাঁচানোর লড়াইয়ে ফের একবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানেই এক বিদ্রোহী, বিপ্লবী নেত্রী ৷ মমতা মানেই দিদি ৷ মমতা মানেই জনমোহিনী এক জনস্রোত ৷ মমতা মানেই বিপুল জনসমর্থন ৷ যে জনসমর্থন বামেদের লাল দুর্গের পতন ঘটিয়েছিল ৷ মমতা মানেই 1984 তেও রক্তিম যাদবপুরে লালেদের পরাজয় ৷ মমতা মানেই সাত বারের সাংসদ ৷ এতগুলো সাফল্য ধরে রেখে কি এবারও নন্দীগ্রাম থেকে তৃণমূলের অস্তিত্বকে বাঁচাতে পারবেন তিনি ৷ ফের একবার অগ্নিকন্যার লড়াই প্রত্যক্ষ করতে পারবে বাংলা?
প্রতীক্ষা 2 রা মে ৷