কলকাতা, 5 ডিসেম্বর : রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা । একটা সময় বেলেঘাটা এলাকার প্রভাবশালী এক নেতার হাত মাথায় ছিল জয়দেব দাসের । সেই থেকেই মাদক ব্যবসার সূত্রপাত । তারপর অবশ্য দূরত্ব বাড়ে । জয়দেব মন দেয় মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়ানোয় । তদন্তকারীদের সন্দেহ, আসলে একটা বর্ম তৈরি করতে চেয়েছিল জয়দেব । সেই কারণেই নানাভাবে রাজনীতি এবং মানবাধিকার সংগঠনকে ব্যবহার করা । গত লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় মানবাধিকার পার্টির তরফে উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীও হয়েছিল । পরে যোগ দেয় একটি রাজনৈতিক দলে । এই সবকিছুর পাশাপাশি চলছিল মাদক ব্যবসার জাল তৈরির কাজ । সেই জাল অবশ্য একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে পুলিশ । আজ পূর্ব কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জয়দেবের তিন সাগরেদকে । তাদের মধ্যে একজন মহিলা ।
28 অক্টোবর বেলেঘাটা রোডে দত্ত নার্সারির সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জয়দেবকে । পুলিশ সূত্রে খবর, তাকে জেরা করে প্রচুর ক্লু পাচ্ছে তারা । পাওয়া যাচ্ছে তার চক্রের লোকজনদের নাম। সেই সূত্রেই গতকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ মাঠ পুকুর ক্রশিংয়ের কাছে এক মহিলা এবং দুই যুবককে আটক করে পুলিশ । তাদের নাম দীপ্তি বিশ্বাস (45), মনু মল্লিক (25), বিট্টু দত্ত (23) । এরমধ্যে দীপ্তির বাড়ি উত্তর 24 পরগনার নিউ ব্যারাকপুর থানা এলাকার বিশ্বাস কলোনিতে । এই তিনজন মাঠপুকুর এলাকায় ছড়িয়ে দিত গাঁজা । ধৃত 3 জনের কাছ থেকে উদ্ধার হয় 12 কেজি 270 গ্রাম গাঁজা । পাওয়া যায় নগদ 91 হাজার 925 টাকাও ।
পূর্ব কলকাতার মাদক জগতের একচ্ছত্র ডন জয়দেব দাস । উপর থেকে দেখলে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। ট্যাংরার অভিজাত আবাসনে থাকত । এছাড়াও লেকটাউন, বাগুইআটি এলাকাতে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট । রয়েছে একটি বিলাসবহুল গাড়িও । মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিতি জয়দেব গত লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় মানবাধিকার পার্টির তরফে উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিল ।
জয়দেব নিয়ে শুরুটা হয়েছিল এ বছরের জুলাইতে । মাদক কারবারের অভিযোগে কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সুব্রত দাস ওরফে শুভ । তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল কয়েক কেজি গাঁজা । শুভকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জয়দেবের নাম পায় পুলিশ। জানা যায়, শুভর সম্পর্কে মামা হয় জয়দেব । 16 জুলাই অ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ স্কুলের সামনে বাইক নিয়ে আসে শেখ রশিদ ইকবাল । তার সঙ্গে ছিল দেড় কেজি গাঁজা । সেগুলি প্যাকেট করে আনা হয়েছিল । প্রত্যেকটি প্যাকেটে ছিল দশ গ্রাম করে । স্কুলের সামনে প্রতিটি প্যাকেট হাজার টাকায় বিক্রি করছিল সে । পুলিশ জানতে পারে পার্ক স্ট্রিট এবং পার্ক সার্কাস এলাকায় স্কুল ও কলেজের পড়ুয়াদের গাঁজা বিক্রি করত রশিদ । 25 জুলাই শরৎ বোস রোডে ন্যাশনাল হাইস্কুলের সামনে গাঁজা বিক্রি করতে এসেছিল দীপ বৈদ্য । তার সঙ্গে ছিল ৩ কেজি গাঁজা । সেগুলিও ছোটো প্যাকেটে ভরে আনা হয়েছিল । প্রত্যেকটি প্যাকেটে ছিল 10 গ্রাম করে ।
প্রত্যেককে জেরা করে জয়দেবের নাম পায় পুলিশ । তখন থেকেই খোঁজ চলছিল তার । 24 অক্টোবর পুলিশের অভিযানে পার্কসার্কাস মার্কেট কমপ্লেক্স এলাকার বাসিন্দা রশিদা বেগম (35), বিবাদীবাগ এলাকার বাসিন্দা মিনা বিবি (34), বউবাজার এলাকার সেলিনা বেগম (40) এবং তপসিয়া রোডের বাসিন্দা সচিন রায়কে গ্রেপ্তার করা হয় । তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় 23 কেজি গাঁজা । তাদের জেরা করেও পাওয়া যায় জয়দেবের নাম । পরে মধ্যপ্রদেশের এক ব্রাউন সুগার কারবারিকেও জেরা করে পাওয়া যায় জয়দেবেরই নাম । কয়েকজন ইয়াবা মাদকের কারবারির মুখেও উঠে আসে একই নাম । বারবার জয়দেবের নাম উঠে আসার এলাকা সহ শহরের সব প্রান্তেই কতোটা জায় ছড়িয়েছিল সে পুলিশ বুঝতে পারে । এরপর আটঘাট বেঁধে তদন্তে নামে তারা । জানতে পারে, জয়দেব নিজে মাদক পাচার করত না । দলের অন্যদের দিয়ে সেই কাজ করাত । নিজে থেকে যেত পরদার আড়ালে ।
27 অক্টোবর বিশেষ সূত্রে পুলিশ খবর পায়, জয়দেব নিজেই শিয়ালদায় আসবে চরস পাচার করতে । এরপর পুলিশ অভিযান চালায় । গোয়েন্দারা এক নম্বর বেলেঘাটা রোডে দত্ত নার্সারির সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে জয়দেবকে । তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় এক কেজি একশো গ্রাম চরস । যার বাজারদর প্রায় 1 লাখ টাকা । এরপর জয়দেবকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে যায় পুলিশ ।
শিয়ালদা থেকে সোজা ট্যাংরায় জয়দেবের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশের দল । সে সময় বাড়িতে ছিল জয়দেবের স্ত্রী গৌরি । প্রথমে দরজা খুলতে চায়নি সে । পুলিশ দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে । দরজা খুলতেই পুলিশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দু'টি কুকুর । একটি ডোভারম্যান, অন্যটি রটউইলার । পুলিশ বুঝতে পারে পরিকল্পনা করে এই কাজ করা হয়েছে । একদিকে তখন ফ্ল্যাটের ভেতর চলছিল গাঁজায় আগুন দিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, অন্যদিকে সময় নেওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে কুকুর । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তলব করা হয় কলকাতা পুলিশের ডগ স্কয়্যাডের হ্যান্ডেলারদের । তারা এসে কাবু করে দুই কুকুরকে । কিন্তু তার আগে একটি কুকুর কামড়ে দেয় স্কয়্যাডের সদস্য অমিত মণ্ডলকে । পরে জয়দেবের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয় 21 কেজি 800 গ্রাম গাঁজা । পুলিশ জয়দেবের স্ত্রী গৌরিকেও গ্রেপ্তার করে ।