কলকাতা, 4 এপ্রিল : চিকিৎসা বিভ্রাটের ফলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক কিশোরীর মৃত্যু । লকডাউনের জন্যই এই অঘটন । আক্ষেপ পরিবারের ।
হাওড়ার বাগনানের দেওলটির বাসিন্দা ওই কিশোরীর নাম সুজাতা প্রামাণিক । সে ক্লাস এইটে পড়ত । সুজাতার মামা প্রদীপ দোলোই বলেন, " দুই মাস যখন বয়স, তখন থেকেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে সুজাতাকে নিয়মিত রক্ত দিতে হত ।" এদিকে, থ্যালাসেমিক গার্জেনদের অ্যাসোসিয়েশনের একটি সেন্টার রয়েছে উত্তর কলকাতায় । এই সেন্টারে প্রতি মাসে দুই বার এই কিশোরীকে রক্ত দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা হত । কিশোরীর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, 15 দিন অন্তর রক্ত দেওয়া হত তাকে । সেক্ষেত্রে পরবর্তী দিন হিসাবে নির্ধারিত ছিল গত 20 মার্চ। ওইদিন ছিল জনতা কারফিউ ।
লকডাউনের এই পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা কী করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান এই কিশোরীর পরিজনরা । যদিও, 15 দিনের সময় বাড়িয়ে 20 দিন পর্যন্ত করা যেতে পারে । অর্থাৎ, 15 দিন থেকে শুরু করে 20 দিনের মধ্যে রক্ত দেওয়া যেতে পারে । কলকাতার ওই সেন্টারের সঙ্গে গত 25 মার্চ ফোনে যোগাযোগ করেন সুজাতার বাবা অজিত প্রামাণিক । লকডাউনের কারণে 24 মার্চ থেকে কলকাতার ওই সেন্টারের পরিষেবা কয়েক দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল । তাই অজিতবাবুকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পরিস্থিতির কারণে ওই সেন্টারটিকে জীবাণুমুক্ত না করে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না । এই অবস্থায় সরকারি কোনও হাসপাতালে এই কিশোরীকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় ।
সুজাতার মামা বলেন, " গাড়ি ভাড়া করে 27 মার্চ সুজাতাকে আমরা তমলুক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম । ওখানে রক্ত পাওয়া যাবে কি না, তার খোঁজ আমরা আগের দিন নিয়ে এসেছিলাম । রক্তের জন্য আমাদেরকে ডোনার নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল । আমরা ডোনার নিয়ে গিয়েছিলাম ।"
তাঁর অভিযোগ, " রক্ত দেওয়ার জন্য প্রথমে ভেইন খুঁজে পাচ্ছিলেন না হাসপাতালের নার্সরা । তিন-চার জায়গায় সুঁচ ফুটিয়ে দেখেন তাঁরা । এরপরে সুজাতাকে ওরা হোল ব্লাড দেওয়া শুরু করেন । অর্ধেকের মতো রক্ত দেওয়ার পরে সুজাতার জ্বর চলে আসে । জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটার এবং জ্বর কমানোর ওষুধ আমাদের কিনে দিতে হয় ।" এই অবস্থায় কলকাতার ওই সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এই কিশোরীর পরিবার । এই সেন্টার থেকে বলা হয়, হাসপাতালে যেন বলা হয় যে কিশোরীকে যেন হোল ব্লাড না দেওয়া হয় ।
এদিকে, হাসপাতালের যে ঘরে এই কিশোরীকে রক্ত দেওয়া হচ্ছিল, সেই ঘরের তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে ঘামতে শুরু করে সে । শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দেখা দেয় । সুজাতার মামা বলেন, " আমাদের একটা ভুল হয়েছিল, সুজাতাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া । রাতে ওর শরীরে যন্ত্রণা শুরু হয় । পরের দিন সকালে ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে, কাউকে চিনতে পারছিল না।" গত 28 মার্চ গাড়ি ভাড়া করে সুজাতাকে এবার উলুবেড়িয়ার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ।
সুজাতার মামার অভিযোগ, " প্রথমে এই হাসপাতালে সুজাতার চিকিৎসা শুরু করা হয়নি । পরে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ওকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। ওই হাসপাতালে সুজাতাকে ভরতি নিতে চায়নি । ওর জ্বর থাকায় কোরোনা সন্দেহ করা হচ্ছিল । এরপরে অক্সিজেন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে আমরা SSKM হাসপাতালে নিয়ে আসি ।" তিনি আরও বলেন, "রাতের দিকে কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার রিপোর্ট রাত 11টা নাগাদ দেওয়ার কথা ছিল । আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, বড় জায়গায় ভরতি করিয়ে দিয়েছি । কিছু না কিছু ব্যবস্থা করা হচ্ছে । রাত ন'টা নাগাদ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পারি, সুজাতার ইউরিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ওর ব্লাড প্রেসার নেমে গিয়েছে । ওর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । ওকে বাঁচাতে পারার আশা খুব কম । রাত 12টা 50 মিনিট নাগাদ ওর মৃত্যু হয়।" কিশোরীর মামা প্রদীপ দোলোই বলেন, " 15 দিন পরে রক্ত দেওয়ার দিন ছিল। কলকাতায় আসার জন্য যখন ফোন করা হয়েছিল, তখন 18 দিন। কলকাতার সেন্টারে কবে পরিষেবা চালু হবে, সেটা তখন ঠিক ছিল না। 20 দিনের মাথায় সুজাতাকে আমরা তমলুক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। লকডাউন শুরু না হলে সুজাতাকে এভাবে আমাদের হারাতে হত না।" যদিও, এই ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি পরিজনরা।
এই কিশোরীর বাবা পেশায় একজন দিনমজুর । তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে, কলকাতার এই সেন্টার থেকে এই কিশোরীর জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । থালাসেমিক গার্জিয়ানদের অ্যাসোসিয়েশনের কলকাতার ওই সেন্টারের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা, এই অ্যাসোসিয়েশনের একজন সদস্য গৌতম গুহ বলেন, " থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের জন্য হোল ব্লাড অত্যন্ত বিষ । এই কিশোরী এতটা অসুস্থ ছিল না । ওর চিকিৎসা চলত। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে ।"