কলকাতা, 14 এপ্রিল : উৎসবের আলো নেই এঁদের ঘরে। বছরের শেষ বা বছরের শুরু কোনওরকম রেখাপাত করে না বলিরেখা পড়ে যাওয়া মুখগুলিতে। লকডাউনের জেরে আপাতত রুজি-রোজগার বন্ধ । তাই বিপাকে পড়েছেন রিকশা চালকরা ।
নতুন বছরে মিষ্টি তো দূর একমুঠো চিনি বা গুড় ঘরে নেই বাবলু বণিকের। বাড়িতে অপেক্ষা করে রয়েছেন পাঁচজন সদস্য। সামান্য বাজার করার টাকা নেই পকেটে। বাবলু বণিক গত 46 বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন। এমন অনটন সংসারে অতীতে হয়নি। এমন সংকটও আসেনি । দুঃখের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেললেন তিনি। অকালে বাপ চলে যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল কিশোর বাবলুকে। বাধ্য হয়ে স্কুলের পড়া ছেড়ে তিন চাকার রিকশাই ছিল তার বেঁচে থাকার অন্যতম আশ্রয়।
পাঁচ ভাই বোনের সংসার। বাবার মৃত্যুর পর লোকের বাড়িতে ঠিকে কাজ ধরেন মা। তিন বোনকে বিয়ে দিতে হয়েছে। এক ভাই। সেও রিকশা চালায়। কিন্তু এমন দুর্বিপাকে পড়েননি এরা কেউ। বলছেন আর এক রিকশা চালক ।
উত্তর 24 পরগনার হালিশহরের স্টেশন রোডের রিকশা চালকরা সারাদিন বসে থাকেন রিকশা স্ট্যান্ডে। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে দু সপ্তাহ হয়ে গেল। যাত্রীদের আনাগোনা নেই। এমনিতেই টোটো এবং অটো হয়ে যাওয়াতে রিকশার বাজারে মন্দা। তারউপর এই লকডাউনে পেটে গামছা বাঁধার জোগাড়। দিনে কুড়ি টাকা উপার্জনের পথ নেই। তাই বাড়িতে ফিরতে ভয় পান সুনীল, বিকাশ, পিন্টুরা। বাড়িতে গেলেই অসহায় মুখগুলো দেখতে হয় । সরকারি ত্রাণ পৌঁছয়নি এদের কারও কাছে। প্রতিবেশীরা যা দেন, তা দিয়েই কয়েকদিন চলছিল। "প্রতিদিন তো আর লোকে চাল-ডাল দেবেনা" বলছিলেন বাবলু বণিক।
সুবল মজুমদার নাকে রুমাল বেঁধে রিকশা গ্যারেজে বসে রয়েছেন। গত বাংলা বছরের প্রথম দিনে বেশ ভালো আয় হয়েছিল তাঁর। দুপুরে বাড়িতে খেতে যাওয়ার সময় মাংস নিয়ে গেছিলেন। কোরোনা আতঙ্ক এবছরের চিত্রটা বদলে দিয়েছে। প্রায় মাসখানেক হল রিকশায় কেউ ওঠে না। সারাদিন যাত্রীদের অপেক্ষায় থেকে রাতে মাত্র কয়েকটি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় ।
দুবেলা পেট ভরে দুটো ভাত পেলে আর কিছু চাই না তাদের। কিন্তু এভাবে আর কয়েক দিন চললে আত্মহত্যা করতে হবে বলে জানালেন কয়েকজন রিকশাচালক। 6 জনের সংসার আয় কিছুই নেই। আজ সারাদিনে রিকশা চালিয়ে মাত্র দশ টাকা পকেটে এসেছে। বছরের প্রথম দিনে এই টাকা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে কার মুখে খাবার তুলে দেবেন বছর বিয়াল্লিশের দীপক রায় । মাথায় হাত দিয়ে রিকশার পাদানিতে বসে পড়লেন তিনি।
কোরোনা ভাইরাস, গৃহবন্দী, লকডাউন বিষয়গুলি এদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রিকশার চাকা ঘুরলে এঁদের জীবনের চাকা এগিয়ে চলে। এই মুহূর্তে এলাকায় প্রায় 86 জন রিকশা চালক অর্ধাহারে রয়েছেন । জমানো টাকা ভেঙে খরচ হচ্ছে নিয়মিত। এবার ভাঁড়ারে টান পড়েছে। এখন সুদিনের অপেক্ষা ।