কলকাতা, 4 ডিসেম্বর : বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে স্পেশালাইজ়ড ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজন । যেখানে তাদের স্পেশাল কেয়ার নেওয়া সম্ভব হবে । ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ পারসন্স উইথ ডিজ়েবিলিটিসে এমনই আবেদন রেখেছেন ডক্টর (PHD) মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি । এর পাশাপাশি পারসন উইথ ডিজ়েবিলিটিদের নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছেন । এমন পরিচয়ের পাশাপাশি ২০১৯-এর বেস্ট রিসার্চ ইন দ্য এরিয়া অফ ডিজ়েবিলিটি-র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এম্পাওয়ার্মেন্ট অফ পারসন্স উইথ ডিজ়েবিলিটিস সম্মানের প্রাপকও তিনি ।
পারসন্স উইথ ডিজ়েবিলিটিস, পরিস্থিতি এখন কী রকম ?
মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, গত বছর থেকে এ বছর মাঝখানে ৩৬৪ দিন আমরা যাঁরা কাজ করি, অনেক জায়গায় প্রত্যেকদিনই বুঝি কিছু না কিছু ভাবে সবাই একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সাহায্যের জন্য । একটু একটু করে হাত বাড়াচ্ছে । যার ফলে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষরা, যাঁরা নানান প্রতিবন্ধকতা নিয়ে রয়েছেন, তাঁদের পায়ের তলার মাটি একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে । এখনকার পরিস্থিতি একদম ঠিকঠাক আছে, যতটা পাওয়ার ততটাই পাওয়া যাচ্ছে সমাজ থেকে এ কথা বলতে পারব না । কিন্তু, আমরা একটু করে সাহায্যের আশ্বাস পাচ্ছি সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে । এর ফলে যাঁরা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করি, তাঁদের কিছু সুবিধা অবশ্যই হচ্ছে । আগের বছর থেকে এ বছর প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সাহায্যের হাত পেয়েছি, আগামী বছর সবার কাছে থেকে আরও কিছু পাব বলে আশা রাখি । সমাজ, সরকারি স্তরের সাহায্য নয়, একেবারে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে আশা করছি ।
প্রতিবন্ধকতা মানে হচ্ছে অন্ধকার । এই বিষয়টি থেকে একেবারে বেরিয়ে আমরা আলো দেখছি । সেই আলো থেকে প্রতিদিন অ্যাক্সেসিবিলিটি বাড়ছে । আগে যা ছিল তার থেকে গ্রহণযোগ্যতা যেহেতু বেড়েছে, তাই আরও একটু শক্ত হচ্ছে ভবিষ্যতের মাটি । এই ধরনের মানুষদের কাজের সুযোগ বাড়ছে । রোজকার মেলায় এখন প্লেসমেন্ট দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা হয় । এখানে কতজনের ঠিকঠাক প্লেসমেন্ট হল বা প্লেসমেন্টেরর জন্য তারা উপযুক্ত কি না, তার থেকে এই উদ্যোগটিই বড় বিষয় । যদি বলি, এদের ভবিষ্যত আর কোনও সমস্যা নেই, তা নয় । বিশেষভাবে যারা সক্ষম তাদের ভবিষ্যৎ একেবারে সুরক্ষিত না হলেও মানুষ আজকাল বোঝে । সাহায্য করে, আগের পরিস্থিতি অনেকটাই পালটেছে ।
তা হলে, সমস্যা কোথায়?
মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর, সমস্যা রয়েছে । এমন বলতে পারি না যে পারসন উইথ ডিজ়েবিলিটিদের প্রতি সমাজের নেগেটিভ অ্যাটিটিউড নেই । প্রতিটি স্কুল-কলেজে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি মানুষকে বোঝানোর যে তারাও আর পাঁচটা মানুষের মতোই । কিন্তু, তার মানে এই নয় যে সমস্যা নেই । পারসন উইথ ডিজ়েবিলিটিদের জন্য সত্যিকারের সেই লেভেলের অ্যাটিটিউড তৈরি হতে আরও অনেকটা এগোতে হবে আমাদের । সমাজের প্রতিটি স্তরেই সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক যুদ্ধ করতে হবে । হাত বাড়ানো বলতে করুণা নয়, সিমপ্যাথি ছাড়া এমপ্যাথির হাত বাড়ানো দরকার । যে মানুষটি চলতে পারেন না, তিনি বাকি দু'টি হাত দিয়েও অনেক কিছু করতে পারেন । অনেক কিছু করার সেই অবস্থা পর্যন্ত যেতে পারেন । এর বোধ কিন্তু অন্য মহলের থাকা দরকার । সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে আগের থেকে অ্যাক্সেসিবিলিটি বাড়ছে । কিন্তু, তার মানে এটা নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে । তাহলে আমাদের আর এই যুদ্ধ করতে হত না ।
ডিজ়েবিলিটি মানে, যার যতটুকু ক্ষমতা ততটুকু দিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, তা কিন্তু আমাদের সমাজে সত্যি হচ্ছে না । যার যতটুকু ক্ষমতা, সেটুকু বোঝার মতো ক্যাপাসিটি বোধ হয় উলটো দিক থেকে নন ডিজ়েবেল পার্সনদের সকলের নেই । সবার পক্ষ থেকে আরও অনেক বেশি সচেতনতা দরকার । ধরুন, অটিজ়ম । অটিজ়মের একটি ছেলে বা মেয়ে কথা বলছে না । কিন্তু, অনায়াসে কাঁথায় অসম্ভব সুন্দর স্টিচ করে দিতে পারছে । তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, সেলাই করতে পারবে? সে উত্তর দিল না । সে নাকচ হয়ে গেল । কিন্তু বুঝতে হবে যে, এর মধ্য থেকে হ্যাঁ পারবটা অন্য রকম ভাবে বেরিয়ে আসবে । হয়তো হ্যাঁ পারব বলে নয় । এ রকম উদাহরণ প্রায় সব জায়গায় রয়েছে । ওদের অ্যাক্সেস করার জন্য সঠিকভাবে বোঝার ক্ষমতাটা এখনও কিন্তু সমাজের সব স্তরে হয়নি । আমাদের আরও আরও আরও এমন দরকার, যাতে সবার বন্ধুত্বের হাত আমরা পেতে পারি ।
কীভাবে সম্ভব?
সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প হচ্ছে । আমার মনে হয়, প্রত্যেকটি টিভি, রেডিয়ো, মাস মিডিয়ায় বছরের একদিন নয় । প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়ে যাওয়া উচিত । কেউ হয়তো সিরিয়াল দেখেন । সেখানেও কিছু সচেতনতা দরকার । যেমন, ডিজ়েবিলিটির একটি চরিত্র দিয়ে হাস্যকৌতূকের চরিত্র করা হলে, তার প্রতিবাদ দরকার । এটাও একটি অ্যাওয়ারনেস । অর্থাৎ প্রত্যেক সময়, প্রত্যেক জায়গায় অ্যাওয়ারনেস দরকার । এটার জন্য সরকারের তরফে অনেক বেশি অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্প করতে হবে ।
বিভিন্ন NGO বা প্রশাসনের তরফে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচার যতটা হয়, ততটা কিন্তু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে প্রচার হয় না । সেখানেও প্রচার বেশিমাত্রায় দরকার । অনেক সময় পুলিশকেও বোঝাতে হয়, ডিজ়েবিলিটির মানে কী? ডিজ়েবিলিটিকে সাপোর্টের জন্য প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি জায়গায় অনেক বেশি প্রচারের প্রয়োজন ।
স্বাস্থ্য, শিক্ষার বিষয়টি ?
সরকারি-বেসরকারি সব বড় হাসপাতালগুলিতে, এই বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য বেড রাখা যাবে না, যদি কিছু করে । এই ধরনের মানুষকে যে একটু অন্যভাবে চিকিৎসা করতে হবে, সেই অ্যাওয়ারনেস নেই । হাসপাতালগুলিতে একটি সেক্টর রাখা উচিত, যেখানে এদের জন্য স্পেশাল কেয়ার নেওয়া সম্ভব হবে । যারা একটু সচেতন, যারা বুঝতে পারবেন, কোন ধরনের ডিজ়েবিলিটিতে, কীভাবে সামলাতে হবে । এর জন্য একটা সেকশন রাখা দরকার ।
আর এদের মেইনস্ট্রিমের এডুকেশন নেওয়ার ক্ষমতা যদি থাকে, সেটা খুঁজে নেওয়ার জন্য সঠিক লোকের প্রয়োজন । এটা করে যাতে মেইনস্ট্রিমের এডুকেশনের সুযোগ দেওয়া হয় । যদি মেইনস্ট্রিমে খানিকটা যেতে পারে, যদি সে এইট পাস করতে পারে, স্কুল ফাইনাল পাস করতে পারে, তা হলে ভবিষ্যৎ সুগম হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে । যদি এভাবে সম্ভব না হয়, তাহলে অন্য কোনওভাবে ভবিষ্যৎ সুগম হয়ে উঠতে পারে । মেইনস্ট্রিম এডুকেশনের জন্য সমস্ত লেভেলে একেবারে স্পষ্টভাবে সঠিক অ্যাটিটিউড চাই, যাতে বিশেষভাবে সক্ষম এমনটা বুঝে নিয়ে, তাদের জন্য বাকি সুবিধা দেওয়া যায় ।
সরকারের এই ক্ষেত্রে পলিসি রয়েছে, কাউকে ফেরাতে পারবে না । এই পলিসি কতটা ভালো, আমি জানি না যতক্ষণ না আমরা নিজেদের সেই ভাবে তৈরি করতে পারছি । আটকে রাখার জন্য নয়, সঠিক হোমের দরকার । যেখানে মা-বাবা নিশ্চিন্তে তার সন্তানকে রেখে থাকতে পারবেন ।