কলকাতা, 16 অক্টোবর : দুর্গোৎসবে পুজো কমিটিগুলোর থিম পুজোয় একে অপরকে টক্কর দেওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে বহু বছর ধরে । প্রতি বছরই সৃজনশীলতা, শিল্প, ভাবনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বার্তা বহনকারী থিমের পুজো মণ্ডপ ও তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিমার মাধ্যমে মানুষের নজর কাড়ার চেষ্টা করে আসছে ছোট থেকে বড় পুজো উদ্যোক্তারা । কিন্তু, এই থিম পুজোর স্রষ্টা কে? কবে থেকে আর কারই বা হাত ধরে চালু হয়েছিল থিম পুজোর রেওয়াজ? জানে না সাধারণ মানুষ । তাই এবছর দুর্গোৎসবে থিম পুজোর স্রষ্টা 'অশোক গুপ্ত'কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে নিজেদের পুজো মণ্ডপ ও প্রতিমা গড়ছে জগৎ মুখার্জি পার্ক । উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষকেও থিমের স্রষ্টার সম্পর্কে অবগত করা ।
এবছর 84 বছরে পা দিল জগৎ মুখার্জি পার্কের দুর্গোৎসব । বর্তমান সময়ে চলা প্যানডেমিকের কথা মাথায় রেখে মানুষকে একটু উৎসবের আনন্দ দিতে চায় এই পুজোর উদ্যোক্তারা । এবারও থিমপুজোই হচ্ছে জগৎ মুখার্জি পার্কে । থিম শিল্পী সুবল পাল । ভাবনা 'যতকাল রবে থিমের দুর্গা পুজো, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, গঙ্গানদী, কলকাতা, জগৎ মুখার্জি পার্ক, স্মরণে রবে স্যার অশোক গুপ্ত' । এবছর তাঁদের ভাবনা নিয়ে শিল্পী সুবল পাল বলেন, "এবার জগৎ মুখার্জি পার্ক থিম পুজোর স্রষ্টা যিনি তাঁকে একটা ট্রিবিউট জানাচ্ছি । স্যার অশোক গুপ্ত, যিনি 1959 সালে এই জগৎ মুখার্জি পার্কেই প্রথম থিম পুজোর সৃষ্টি করেছিলেন । তখন চারদিকে সাবেকিয়ানা । সেই সময় দাঁড়িয়ে উনি তৎকালীন ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করেন । তখন সাবেকিয়ানার ফর্মটাকে ভেঙে একদম অন্য ধরনের একটি দুর্গা প্রতিমা গড়েছিলেন । সেই মানুষটাকেই এবার ট্রিবিউট জানাচ্ছি । কারণ, আমরা যাঁরা দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই জানি তাঁর সম্পর্কে । কিন্তু, সাধারণ মানুষ কিন্তু এখনও জানে না যে, আসলে এই সৃষ্টির স্রষ্টা কে । সেই মানুষটিকে একটু আলোকিত করা হচ্ছে যাতে সবাই তাঁকে চিনতে পারে । "
1959 সালে জগৎ মুখার্জি পার্কে প্রথম সাবেকিয়ানার বদলে অন্যরূপী প্রতিমা গড়ে থিমপুজোর সূচনা করেছিলেন অশোক গুপ্ত । তখনকার দিনের থিমপুজো এখনকার থিমপুজোর মতো ছিল না । তখন সাবেকি প্রতিমাকে অন্য রূপে দেখানোটাই ছিল থিম । অশোক গুপ্ত তৎকালীন ঘটনা অথাৎ, কখনও নকশাল আন্দোলন, কখনও পরমাণু বিস্ফোরণের উপর ভিত্তি করে দুর্গা মূর্তি গড়তেন । শিল্পী সুবল পাল বলেন, " তাঁর গড়া প্রতিমা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের হত । উনি একটা বোর্ডের উপর রিলিফ ওয়ার্ক করতেন । আমাদের দুর্গা প্রতিমাটা দেখলেই বোঝা যাবে যে ওনার ধরনেই করা । যা দেখলে একটা পেন্টিং মনে হবে । উনি এতো বড় শিল্পী ছিলেন যে ওঁনাকে অনুকরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । তাই ওঁনাকে অনুসরণ করে আমরা যেটুকু পারছি করছি । "
থিমের স্রষ্টা অশোক গুপ্তকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে এবার 60-এর দশকে ফিরছে জগৎ মুখার্জি পার্ক । ওই দশকের সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটি আর্ট গ্যালারির রূপ দেওয়া হচ্ছে মণ্ডপটিকে । এমনভাবে সাজানো হচ্ছে এই আর্ট গ্যালারিকে যাতে মনে হয় 'অশোক গুপ্ত'র শিল্প সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে সেখানে । সুবল পাল বলেন, " আমরা আমাদের মণ্ডপটাকে ষাটের দশকের ওঁনার সময়কার একটি আর্ট গ্যালারির রূপ দিচ্ছি । যেখানে ওনার দুর্গা প্রতিমা সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে । আর্ট সংক্রান্ত সমস্ত কাজ থাকছে । শিল্পের ডেফিনেশন হিসেবে আমরা একটা ফাউন্টেন তৈরি করছি । উনি প্রথম দূর্গা মূর্তির স্কাল্পচারে থার্মোকলের ব্যবহার করেছিলেন, যখন লোকে থার্মোকলের নামও শোনেনি । সেই রকম কিছু আর্টওয়ার্ক থাকছে যেটা ওনাকে রিপ্রেজ়েন্ট করছে । উনি যে রকম কাজ করতেন সেটা নিয়ে মানুষকে ভাবাবে । "
জগৎ মুখার্জি পার্কের এই পুজো কমিটির নাম 1 নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ দুর্গোৎসব ও পুজোসমিতি । বর্তমান পরিস্থিতিতে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিয়ে এই সমিতির যুগ্ম সম্পাদক দ্বৈপায়ন রায় বলেন, " খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের পুজো হচ্ছে । কারণ, মানুষের সুরক্ষা সবথেকে আগে । পুজোটা একটা আনন্দের ব্যাপার । সেই আনন্দকে রাখতে গেলে মানুষ যদি মনে করেন তাঁরা ভিড়ের মধ্যে আসতে চান না, আমরা বাইরে একটা LED স্ক্রিন লাগিয়ে দিচ্ছি, সেখান থেকে ঠাকুর দেখে চলে যেতে পারবেন । এছাড়া আমরা গোল গোল দাগ কেটে দিচ্ছি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য । একসঙ্গে 20 জনকে দর্শনের জন্য প্রবেশ করতে দেওয়া হবে । রাখছি মাস্ক । কেউ মাস্ক পড়ে না এলে তাঁকে আমরা মাস্ক পড়ে ভিতরে মণ্ডপ ও প্রতিমা দেখার সুযোগ করে দেব । থাকছে থার্মাল গান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার । এভাবেই আমরা পরিকল্পনা করেছি । "