কলকাতা, 2 ডিসেম্বর : চিত্র 1, ধবধবে সাদা ফুলহাতা পাঞ্জাবি-পাজামা । হাতে দলের পতাকা । সঙ্গী অনুগামীরা ।
চিত্র 2, ধবধবে সাদা ফুলহাতা পাঞ্জাবি-পাজামা । হাতে দেশের জাতীয় পতাকা । সঙ্গী কয়েকশো অনুগামী ।
দশ বছরে পরিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র পতাকার । হয়তো গুণতির হিসেবে পরিবর্তন এসেছে সঙ্গী সংখ্যায় । আর তাতেই যেন ছবি-পরস্থিতি অনেকটা পালটে গিয়েছে । অনেক কিছু বলে দিচ্ছে ।
তৃণমূলের এককালের 'যুবরাজ' শুভেন্দু অধিকারী আজ যেন শুধুই নেতা ।
নন্দীগ্রাম পরবর্তী তৃণমূল । নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী তিনি । নেত্রী যখন যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে তিনিই । দলের অন্দরে কান পাতলে একটা গুঞ্জন শোনা যেত । তাঁকেই নাকি মমতা সব থেকে বেশি পছন্দ করতেন । আর সেই পছন্দের পুরস্কার হিসেবে বিধায়ক থেকে সাংসদ । থেকে মন্ত্রী । সংসদীয় কমিটির সদস্য । সবই পেয়েছিলেন । সরকারের পাশাপাশি সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব বেড়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর । হয়েছিলেন একাধিক জেলার পর্যবেক্ষক ।
কিন্তু, সুর কেটে যায় আর এক 'যুবরাজ'-এর উত্থানে । দলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান তীব্র হয়েছে । ক্রমেই সরে গিয়েছেন শুভেন্দু আর আজ তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের মাটিতে হাঁটলেও হাতে নেই ঘাসফুলের পতাকা ।
মাস কয়েকের চাপানউতোরের পর দিন দুয়েক আগে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল । কিন্তু, মাত্র 12 ঘণ্টা । অধিকারীর অধিকার নিয়ে টানাপোড়েনের সেই গতিরূপ বদলে গিয়েছে । অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলের অনুযোগ, সংবাদমাধ্যমের কাছে সব বলে দেওয়া ঠিক হয়নি । আর গত কয়েক মাস ধরে চলা বন্দ্যোপাধ্যায়-অধিকারী চাপানউতোরে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে বুধবারের দুপুর ।
এত দিন দলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল । কিন্তু এই পর্বে নন্দীগ্রামের বিধায়ক একটিও হালকা কথা বা কথার কথা বলেননি যা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে । দলের বিরুদ্ধে সরাসরি বলেননি একটি শব্দও ৷ খুব সম্ভবত এই প্রথম বলছেন, (সৌগতকে হোয়াটসঅ্যাপ করে) “মাফ করবেন । আপনাদের সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”
স্বীকার করা হোক বা না হোক, মন্ত্রীপদে শুভেন্দু অধিকারীর পদত্যাগে একাধিক অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল । অস্বস্তি ক্রমাগত বেড়েছে । মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং একদা কুণাল ঘোষ দলের বিরুদ্ধে সরব হলেও এভাবে কখনই টিম গড়ে মোকাবিলা করতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে । তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত অন্য কোনও নেতাকে দলে ধরে রাখতে এতখানি মরিয়া হয়নি ঘাসফুল শিবির ৷
আরও পড়ুন : পান্তা ভাত, মুড়ি খাওয়া ছেলেটা আদর্শের জন্য লড়ছে এবং লড়বে : শুভেন্দু
সন্দেহ নেই এবারের নির্বাচনে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে চলছে তৃণমূল ৷ দলের বেশ কিছু বিধায়ক 'অন্য সুরে' কথা বলছেন ৷ অনেক বিধায়ক প্রকাশ্যেই প্রশান্ত কিশোর সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন । কোচবিহার-দক্ষিণের বিধায়ক দল ছেড়েছেন, ব্যারাকপুরের বিধায়ক একুশের ভোটে দলের প্রার্থী হতে নারাজ, দুর্গাপুরের বিধায়ক বলেছেন, দলে কাজ করার স্বাধীনতা নেই । জগদ্দলের বিধায়ক বলেছেন রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার কথা । ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ক দীপক হালদারের গলাতেও অন্য সুর শোনা গিয়েছে । এমন দৃষ্টান্ত আরও আছে ৷ বছর দশেক আগে যাঁদের কাঁধে ভর করে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড় লালবাড়িতে ঢুকেছিলেন আর তার পর পৌছেছিলেন নবান্নের চোদ্দ তলায়, আজ তাঁদের অনেকেই বিমুখ । এর মধ্যে নতুন সংযোজন অবশ্যই শুভেন্দু অধিকারী ।
আরও পড়ুন :"মাঝেরহাট ব্রিজের জন্য কেন 34 কোটি টাকা নিয়েছে রেল", আক্রমণ মমতার
সব থেকে বড় কথা দলে থাকা অবস্থায় দলের শীর্ষস্তরকে এর আগে কেউ এভাবে বিড়ম্বনায় ফেলেননি । বা ফেলতে পারেনি ৷ কালীঘাটের নেতারা বুঝতে পারছেন, শুভেন্দুর গতিপ্রকৃতি । কিন্তু, তাঁরা সরাসরি কোনও পদক্ষেপ-কোনও কড়া কথা বলতে পারছেন না । তার অন্যতম কারণ, শুভেন্দু এখনও পর্যন্ত দল বা দলনেত্রী-বিরোধী একটা কথাও বলেননি । আর সেজন্যই তাঁকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করাও সম্ভব হচ্ছে না । শুভেন্দুর বিরুদ্ধে সরসারি কোনও অভিযোগ আনতে পারছে না দলের কোর কমিটি । স্বাভাবিকভাবে গলার কাঁটার মতো শুভেন্দু বয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে ।
আবার শুভেন্দুর সাংগঠনির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশও নেই । অতি কঠিন সময়েও, যে জেলার দায়িত্ব পেয়েছেন সেখানেই ঘাসফুল ফুটিয়েছেন । মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরের মতো বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি থেকে বিরোধী দলের বেশ কিছু বিধায়ককে তৃণমূলে এনেছিলেন শুভেন্দু । কর্মস্থল বা রাজনৈতিক দল, এটা ঠিক যে কেউই বিকল্পহীন নন । তবে প্রত্যেকেরই আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য বা গুরুত্ব থাকে । থাকে ক্ষমতা । প্রভাব । শুভেন্দুর বিকল্প হয়তো দল পেয়ে যাবে, কিন্তু সে কি শুভেন্দুর মতো উপযোগী হবেন ? পারবেন শুভেন্দুর মতো ক্যারিশমা বিস্তার করতে? এটা সম্ভবত দলও বোঝে । তাই হয়তো, এখনও কেউ বলছেন না, 'শুভেন্দু দল ছাড়লে ছাড়ুক, কিছু যায় আসে না' ।
এখন প্রশ্ন শুভেন্দু কি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাবেন?
শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে তাঁকে অবশ্যই মুসলিম- অনুগামীদের কথা ভাবতে হবে । ভাবতে হবে গোটা রাজ্যে তাঁকে পছন্দ করেন এমন সংখ্যালঘু সমর্থকদের কথাও । বিজেপিতে যোগ দিলে এই সমর্থন কতখানি অটুট থাকবে, বলা মুশকিল ৷ সে ক্ষেত্রে লাভ হবে তৃণমূলেরই । সেটা নিশ্চয়ই শুভেন্দু চাইবেন না ।
শুভেন্দু নিজেই দল ঘোষণা করতে পারেন । তাতে অবশ্যই তাঁর লাভ বেশি । নিজের সমর্থক, তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশ, কংগ্রেস, এমনকী বামেদের সমর্থনও সে ক্ষেত্রে তিনি পেতে পারেন ৷ কিন্তু, সেই সম্ভাবনা খুব একটা বেশি নেই । এখন রাজ্যে বিধানসভা ভোটের মাস ছয়েক দেরি । নিজে দল তৈরি করে ভোটে লড়াই করার সময় আছে কি? নির্বাচন কমিশন কি সেই সময় শুভেন্দুকে দেবে?
কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেন? এমন সম্ভাবনা কম ৷ একুশের ভোটে এ রাজ্যের কংগ্রেসকে টেনে তোলা অসম্ভব । শুভেন্দু অধিকারী জবাব দিতে চান তৃণমূলকে । কংগ্রেসে যোগ দিলে সেই 'জবাব' দেওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে না ।
তবে, যে প্রশ্নটা এত কিছুর পরও থেকে যাচ্ছে, তৃণমূল (বলা ভাল টিম অভিষেক) কি শুভেন্দুকে দলে সক্রিয়ভাবে রাখতে আগ্রহী ? মঙ্গলবার সৌগত রায় দাবি করেছিলেন শুভেন্দুকে নিয়ে সব সমস্যা মিটে গিয়েছে । কিন্তু, সেটা কি একশো শতাংশ মেনে নেওয়া সম্ভব?
সম্ভব নয় ।
কারণ, যদি সব মিটেই যায় তাহলে কেন বলা হল না, মন্ত্রী পদে তোমার ইস্তফা প্রত্যাহার করো । ফের মন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করো । রাজ্যে এবং দলে ইতিবাচক বার্তা যাবে এতে ।
মঙ্গলবারের ঐক্য- বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই শুভেন্দুর ছেড়ে যাওয়া পরিবহন দপ্তরে একটি সরকারি কমিটি গঠন করা হল ৷ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মঙ্গলবারই জানানো হল, পরিবহন দপ্তরের ওই কমিটির চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে ৷ কেন শুভেন্দু-অভিষেক বৈঠক শেষের আগেই এমনটা করা হল... পরিবহন মন্ত্রীর দপ্তরের অধীনস্থ একটি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন রাজ্যের প্রাক্তন এক পরিবহন মন্ত্রী? কেন এমন সিদ্ধান্ত? যদি সব মিটেই যেত, তাহলে শুভেন্দুর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না কেন ?
তাহলে কি সে দিনের বৈঠক আদৌ সফল হয়েছিল? না'কি, শুভেন্দু অধিকারীকে বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই বার্তা দেওয়া হল, তুমি দলে থাকো বা না থাকো, মন্ত্রিত্ব তোমায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে না । থাকতে হলে এভাবেই থাকতে হবে । একজন সাধারণ বিধায়ক হিসেবে ।
আর তাই তড়িঘড়ি একটা মন্তব্য করে নিজেদের কোর্টে বল টেনে নিয়েছিল তৃণমূল । দলের তরফে বলা হল বৈঠক সফল (এটা সঠিক না বেঠিক কেউ নিশ্চিত ভাবে জানেন না । মধ্যস্থতাকারী সৌগত রায় যা বলছেন, সেটাই মেনে নিতে হচ্ছে ।) । মাত্র 12 ঘণ্টার মধ্যে শুভেন্দুর বিবৃতি । আর যা আমজনতার কাছে শুভেন্দুর মত পরিবর্তন হিসেবেই ধরা দিল ।
দল দেখাল- আমরা ঠিক আছি । আমরা তো শুভেন্দুকে দলেই চেয়েছি । কথা বলেছি । নেত্রীও কথা বলেছেন । মোদ্দা কথা, আমাদের সদিচ্ছা আছে । ছিলও । শুভেন্দুর নেই । উনি মত পালটেছেন । এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না ।