কলকাতা, 28 এপ্রিল : কোনও চিকিৎসক ক্যানসারে আক্রান্ত । কোনও চিকিৎসক আবার কোমায় চলে গেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে অস্ত্রোপচারের পরে । এমন কী, সম্প্রতি ক্যানসারে আক্রান্ত এক চিকিৎসকের মৃত্যুও হয়েছে । অথচ, এই সব সরকারি চিকিৎসক স্বেচ্ছা অবসর চেয়ে আবেদন জানালেও, এখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্য দপ্তরের সবুজ সংকেত মেলেনি । এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি চিকিৎসকরা ফের রাস্তায় নামার কথা ভাবছেন । একই সঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, আর কত অমানবিক হতে পারে সরকার ? আর কত মৃত্যু দেখলে তাঁদের স্বেচ্ছা অবসরের অধিকার ফিরিয়ে দেবে সরকার ?
কোমায় রয়েছেন এক সরকারি চিকিৎসক । এই ধরনের পরিস্থিতি সত্ত্বেও চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর মিলছে না তাঁর । এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, "গত বুধবার, চিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন । তিনি মেডিকেল শিক্ষকদের শিক্ষক ছিলেন । খুব ভালো চিকিৎসকও ছিলেন । তিন বছর আগে তাঁর লিভারের ক্যানসার ধরা পড়ে । অস্ত্রোপচারের সুযোগ ছিল না । ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে । সাত মাস ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন । কার্যত বেহুঁশ ছিলেন তিনি ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই চিকিৎসক স্বেচ্ছা অবসরের জন্য আবেদন করেছিলেন । তাঁকে সরকার মেডিকেল বোর্ডে পাঠায় । প্রায় এক বছর হয়ে গেছে মেডিকেল বোর্ড বলেছিল, এই চিকিৎসককে দিয়ে চাকরি করানো সম্ভব নয় । অথচ, সরকার এখনও পর্যন্ত এই চিকিৎসকের স্বেচ্ছা অবসরের নির্দেশ দেয়নি । সরকারি নির্দেশ বের হওয়ার আগেই এই চিকিৎসকের মৃত্যু হয়ে গেল ।"
শুধুমাত্র এই চিকিৎসক নন । মানস গুমটা বলেন, "এই ধরনের আরও 3-4 জন চিকিৎসক রয়েছেন । তাঁদের মধ্যে একজন কোমায় রয়েছেন । তাঁর চিকিৎসা চলছে । তিনি রিফ্রাক্টরি অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত । এই কারণে তাঁর ব্রেন কাজ করে না । মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়েছে । এর জন্য তাঁর ব্রেনে অস্ত্রোপচারও হয়েছে । এই চিকিৎসক স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন । কিন্তু সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও সাড়া নেই ।" তিনি বলেন, "অন্য এমন আরও দু'জন স্বেচ্ছা অবসরের জন্য আবেদন করেছেন, যাঁরা ক্যানসারে আক্রান্ত । এক জনের প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার । স্টেজ 4-এ রয়েছেন । অন্য একজন চিকিৎসক মাল্টিপল মাইলোমা অর্থাৎ, রক্তের এক ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত । এই ধরনের ক্যানসার নিরাময় হয় না ।" এই সব চিকিৎসক কার্যত এখন মৃত্যুর দিন গুনছেন । সরকারি চিকিৎসকদের এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বলেন, "সরকার কেন এত অমানবিক ? আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই চিকিৎসকদের কেন স্বেচ্ছা অবসর দেওয়া যায় না । এ সব চিকিৎসককে আটকে রেখে সরকারের কী লাভ ? সরকার এমন অমানবিক হতে পারে তা আমাদের ভাবনার বাইরে ।"
সরকারি কর্মী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সবার জন্য একই নিয়ম । যাকে সার্ভিস রুলস বলে । এই রুলসে রয়েছে, যাঁদের বয়স 50 বছর অথবা চাকরির বয়স 20 বছর হয়ে যাবে, তাঁরা ইচ্ছা করলে চাকরি ছেড়ে যেতে পারেন । এটা অধিকারের মধ্যে পড়ে । মানস গুমটা বলেন, "2014 সালে অদ্ভুত কারণে শুধুমাত্র চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা অবসরের এই অধিকারটা কেড়ে নেওয়া হল ।" চিকিৎসকরা আন্দোলনে শামিল হন । কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হন তাঁরা । মামলা করা হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল অর্থাৎ, SAT-এ । মানস গুমটা বলেন, "রাজ্য সরকারকে SAT জানিয়ে দেয়, সার্ভিস রুলসে যা রয়েছে তার ভিত্তিতে চিকিৎসকদেরও স্বেচ্ছা অবসর দিতে হবে । শুধুমাত্র 50 বছর বয়স অথবা, চাকরি জীবনের বয়স 20 বছর নয় । এর বাইরেও যাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে, তাঁরা স্বেচ্ছা অবসর চাইলে তাঁদেরও দিতে হবে । SAT-এর এমন নির্দেশ এখনও বহাল রয়েছে ।"
তিনি বলেন, "চিকিৎসকদের এই স্বেচ্ছা অবসরের অধিকার যেদিন থেকে সরকার কেড়ে নিয়েছে, আমরা আন্দোলনে নেমেছি । আমরা আদালতে মামলা করে জিতেছি । সরকার যেভাবে অমানবিক আচরণ করছে, তাতে মনে হচ্ছে আবার আমাদের রাস্তায় নামতে হবে । খুব শীঘ্রই আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করব । আর কতগুলি মৃত্যু দেখলে আমাদের এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে ?" এই বিষয়টি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন । তিনি বলেন, "সরকার আর কত অমানবিক হবে যে এই মৃত্যুগুলি দেখার জন্য অপেক্ষা করছে ।" বহু সরকারি চিকিৎসক এই একটি বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন । এ রকম ভাবে বেঁধে রাখা যায় না । এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "25 বছর বয়সে চাকরি জীবনে ঢুকবেন আর, 70 বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর পরিবার, ব্যক্তিগত বিষয়, কোনও কিছুই সরকার শুনবে না । শুধুমাত্র বন্ডেড লেবারের মতো আটকে রাখা হবে, এটা হতে পারে না । কোনও সার্ভিসে নেই ।"
সরকারি চিকিৎসকদের অন্য একটি সংগঠন সার্ভিস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেন, "আইন বদল করে চিকিৎসকদের স্বেচ্ছা অবসরের অধিকার সরকার কেড়ে নিয়েছে । স্বেচ্ছা অবসরের বিষয়টি এখন স্বাস্থ্য দপ্তরের উপর নির্ভর করে । এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে ।"
এই বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "পুরো বিষয়টি আমরা অরগানাইজ় করেছি । সব ডেটা দেখা হচ্ছে, কোন কোন চিকিৎসক আবেদন করেছেন । মেডিকেল বোর্ডে পাঠানো হয়েছিল । যে আবেদনগুলি গৃহীত হয়েছে, সেই সব চিকিৎসককে আমরা স্বেচ্ছা অবসর দিয়ে দেব ।"