ETV Bharat / state

কেমন ছিল প্রাণের পুজো ? স্মৃতিসুধায় ডুব - পুজোর স্মৃতিসুধায় নাট্যকার গৌতম হালদার

গ্রামের পুজো । চারিদিকে কাশফুলের বন । সেই পুজো দেখলেই কারও মনে হত, মা যেন সত্যি বাপের বাড়ি এসেছেন । কেউ আবার দলবেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখে বেড়াতেন । ছোটোবেলার দুর্গাপুজোর স্মৃতিতে ডুব দিলেন নাট্যকার গৌতম হালদার ও কবি বিভাস রায়চৌধুরি ।

Durga Puja 2020
গৌতম হালদার ও বিভাস রায়চৌধুরি
author img

By

Published : Oct 24, 2020, 8:14 PM IST

আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । গ্রামের পুজো । ঘুম ভাঙত ঢাকের তালে । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ছোটোবেলার পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন নাট্যকার গৌতম হালদার ও কবি বিভাস রায়চৌধুরি ।

পুজোর স্মৃতিসুধায় নাট্যকার গৌতম হালদার

Durga Puja 2020
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় নাট্যকার গৌতম হালদার

এবারের পুজোর স্মৃতিটা আজীবন থাকবে । এবারের পুজোয় যেভাবে যা কিছু ঘটছে, সেই স্মৃতিটা সারা জীবন থেকে যাবে । আর পুরানো স্মৃতি বলতে সবথেকে বেশি মনে পড়ছে ছোটোবেলার পুজোর ছুটি । স্কুল থেকে হাইস্কুল । হাইস্কুল থেকে কলেজ । পুজোর রং বদলাতে থাকে ।

ছোটোবেলায় থাকতাম মফস্বলে । ভাটপাড়ায় থাকতাম । পঞ্চমী দিন ভোর পাঁচটার সময় ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙত । দেখতাম পাড়ার বেদির উপরে ঠাকুর এসে গেছে । একজন ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছেন । এরপর অনেকগুলি পুজো গ্রামে কাটিয়েছি । চারিদিকে সত্যিকারের কাশফুল । একটা পুজো থেকে অন্য পুজো অনেক দূরে । গ্রামের পুজোর সেই স্মৃতি অপূর্ব । সেই পুজো দেখলেই মনে হয় মা যেন সত্যি বাপের বাড়ি এসেছেন । একেবারে আটপৌরে দুর্গাপুজো ।

এছাড়া আরও যেটা মনে পড়ে, সেটা হল কে ক'টা ঠাকুর দেখল সেই নিয়ে প্রতিযোগিতা । সমবয়সিরা তখন কে ক'টা ঠাকুর দেখল, সেই নিয়ে এক মজার প্রতিযোগিতা হত নিজেদের মধ্যে । আর পুজোয় ক'টা নতুন জামা হবে সেই নিয়েও থাকত চরম উন্মাদনা । তিনটে... না পাঁচটা... ক'টা জামা-প্যান্ট হবে সেই কথা ভেবেই দিন কাটত ।

পুজোর স্মৃতিসুধায় কবি বিভাস রায়চৌধুরি

Durga Puja 2020
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি বিভাস রায়চৌধুরি

আমাদের ছিল ছোটো ছোটো পুজো । কিন্তু আনন্দ ছিল অনেক । কয়েকটা পাড়া মিলে একটা ছোটো ক্লাবে পুজো হত । যার সঙ্গে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকতাম । খুব ছোটোবেলায় যখন মণ্ডপে ঠাকুর আসছে... ঠাকুর বসানো হচ্ছে... ঢাকি এসেছে... আমরা তার কাছ থেকে কাঠি চেয়ে নিয়ে বাজাতাম ঢ্যাং কুড় কুড় ! পুজো বলতেই এই ছবিগুলোই মনে পড়ে । সীমান্ত শহর বনগাঁর মানুষ আমি । উদ্বাস্তু কলোনির ছেলে । কলোনিগুলোতে সারা বছরই দারিদ্র্যজনিত ঝগড়াঝাটি চলত । বাবা-মায়েরা ভীষণ পরিশ্রম করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেন, পড়াতেন ।

কলোনির বন্ধুরা খুব গায়ে-গায়ে থাকতাম । শঙ্খ ঘোষের 'আয় আর‌ও বেঁধে বেঁধে থাকি' ভাবটাই ছিল আমাদের । দলবেঁধে খেলতে যাওয়া, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, পুকুর-নদীতে ঝাঁপ । বেড়া-টালির ঝুপড়িঘরে জায়গা কম ছিল বলে বাইরেটাই ছিল আমাদের প্রিয় পৃথিবী । ঋতু-প্রকৃতির বৈচিত্র্য আমরা অনুভব করতাম খুব । প্রচণ্ড ঝড়ে আম কুড়ানোর কিছুদিন পরে মেঘ-বৃষ্টি... তার পরে একটানা বৃষ্টি, সর্দি কাশি জ্বর । চারদিকে জল । খেলার মাঠ জলে ডুবে গেছে । বাড়ির বারান্দায় জল উঠে আসছে । ঘরে আটকে থাকার এই মনখারাপের সময়ে আমরা ভাবতাম আর কিছুদিন পরেই জল কমে যাবে, কাশ ফুটবে পুকুরপাড়ে দিঘির পাড়ে, নদীতীরে । কালকাসুন্দে ফুল হলুদ আলোয় মাতাবে চারদিক । নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । সেই ভেলায় চড়ে দুর্গা ঠাকুর আসবে । ভাবলেই মনের বিষাদ দূর হয়ে যেত ।

একদিন ভোরবেলা যেই রেডিয়োতে বেজে উঠত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ, আমরা এক ছুটে বেরিয়ে পড়তাম । মহালয়ায় চমকে উঠে দেখতাম পৃথিবী বদলে গেছে । এবার নতুন জামা, ঠাকুর, প্রসাদ আর হ‌ইহ‌ই । দলবেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখে বেড়াব যেমন, তেমন নিজের পাড়ায় পুজোর সঙ্গে সবাই মিলে মিশে থাকব । বড়দের কথায় কলাপাতা আনতে ছুটব । বেলুন কিনব । কলোনিপাড়ায় ঝগড়া কয়েকদিনের জন্য মুছে যাবে । সবাই এখন খুশি-খুশি । মায়েদের গলা এখন নরম । ভালোবাসা খেলা করছে হাওয়ায় । সত্যি সত্যি দুর্গা এসে আমাদের দিনগুলিকে আনন্দে ভরিয়ে দিতেন । বিজয়া দশমী প্রতিমা ভাসানের পরে সবাই বিষণ্ণ । ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে আমাদেরও খুব মন খারাপ হত। বাতাসে তখন ঠান্ডা মিশছে । কিছুদিন পরেই শীতকাল । আমরা আবার মনে মনে ভাবতাম যে শীত এলেই গাছিদাদু খেজুর গাছ কাটবে । সকালে কাঁপতে কাঁপতে আমরা খাব খেজুরের মিষ্টি রস । বড়দের প্রণাম করতে করতে আমি টের পেতাম শীতের সাতভাই কালীতলার মেলাকে ।

আজ যখন আমাদের গ্রামপ্রধান নিঝুম জায়গাটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মফস্বল শহরে পরিণত হয়েছে, চারদিকে বড় বড় পুজো, তখন আমার কিন্তু সেই দিনগুলোকে অনেক বেশি আপন বলে মনে হয় । কারণ সেই পুজোর সঙ্গে মিশে থাকত আমাদের বেঁচে থাকা । ঝকমকে পুজো থেকে আমি দূরে থেকেছি বরাবর । কোরোনার কারণে এ বছর পুজোর জাঁকজমক কমেছে অনেক । সেদিনের পুজোর সঙ্গে অনেক মিল পাচ্ছি । পাড়ার পুজোয় আবার দেখা করছে সবাই । মৃত্যুভয়, গৃহবন্দিত্বের পর চেনা মানুষের গন্ধের জন্য আবার আকুল হয়েছে মানুষ । এই আকুলতা ছাড়া দুর্গাপুজো বৃথা । ভালোবাসাই তো জীবনব্যাপী মূল উৎসব ।

আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । গ্রামের পুজো । ঘুম ভাঙত ঢাকের তালে । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ছোটোবেলার পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন নাট্যকার গৌতম হালদার ও কবি বিভাস রায়চৌধুরি ।

পুজোর স্মৃতিসুধায় নাট্যকার গৌতম হালদার

Durga Puja 2020
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় নাট্যকার গৌতম হালদার

এবারের পুজোর স্মৃতিটা আজীবন থাকবে । এবারের পুজোয় যেভাবে যা কিছু ঘটছে, সেই স্মৃতিটা সারা জীবন থেকে যাবে । আর পুরানো স্মৃতি বলতে সবথেকে বেশি মনে পড়ছে ছোটোবেলার পুজোর ছুটি । স্কুল থেকে হাইস্কুল । হাইস্কুল থেকে কলেজ । পুজোর রং বদলাতে থাকে ।

ছোটোবেলায় থাকতাম মফস্বলে । ভাটপাড়ায় থাকতাম । পঞ্চমী দিন ভোর পাঁচটার সময় ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙত । দেখতাম পাড়ার বেদির উপরে ঠাকুর এসে গেছে । একজন ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছেন । এরপর অনেকগুলি পুজো গ্রামে কাটিয়েছি । চারিদিকে সত্যিকারের কাশফুল । একটা পুজো থেকে অন্য পুজো অনেক দূরে । গ্রামের পুজোর সেই স্মৃতি অপূর্ব । সেই পুজো দেখলেই মনে হয় মা যেন সত্যি বাপের বাড়ি এসেছেন । একেবারে আটপৌরে দুর্গাপুজো ।

এছাড়া আরও যেটা মনে পড়ে, সেটা হল কে ক'টা ঠাকুর দেখল সেই নিয়ে প্রতিযোগিতা । সমবয়সিরা তখন কে ক'টা ঠাকুর দেখল, সেই নিয়ে এক মজার প্রতিযোগিতা হত নিজেদের মধ্যে । আর পুজোয় ক'টা নতুন জামা হবে সেই নিয়েও থাকত চরম উন্মাদনা । তিনটে... না পাঁচটা... ক'টা জামা-প্যান্ট হবে সেই কথা ভেবেই দিন কাটত ।

পুজোর স্মৃতিসুধায় কবি বিভাস রায়চৌধুরি

Durga Puja 2020
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি বিভাস রায়চৌধুরি

আমাদের ছিল ছোটো ছোটো পুজো । কিন্তু আনন্দ ছিল অনেক । কয়েকটা পাড়া মিলে একটা ছোটো ক্লাবে পুজো হত । যার সঙ্গে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকতাম । খুব ছোটোবেলায় যখন মণ্ডপে ঠাকুর আসছে... ঠাকুর বসানো হচ্ছে... ঢাকি এসেছে... আমরা তার কাছ থেকে কাঠি চেয়ে নিয়ে বাজাতাম ঢ্যাং কুড় কুড় ! পুজো বলতেই এই ছবিগুলোই মনে পড়ে । সীমান্ত শহর বনগাঁর মানুষ আমি । উদ্বাস্তু কলোনির ছেলে । কলোনিগুলোতে সারা বছরই দারিদ্র্যজনিত ঝগড়াঝাটি চলত । বাবা-মায়েরা ভীষণ পরিশ্রম করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেন, পড়াতেন ।

কলোনির বন্ধুরা খুব গায়ে-গায়ে থাকতাম । শঙ্খ ঘোষের 'আয় আর‌ও বেঁধে বেঁধে থাকি' ভাবটাই ছিল আমাদের । দলবেঁধে খেলতে যাওয়া, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, পুকুর-নদীতে ঝাঁপ । বেড়া-টালির ঝুপড়িঘরে জায়গা কম ছিল বলে বাইরেটাই ছিল আমাদের প্রিয় পৃথিবী । ঋতু-প্রকৃতির বৈচিত্র্য আমরা অনুভব করতাম খুব । প্রচণ্ড ঝড়ে আম কুড়ানোর কিছুদিন পরে মেঘ-বৃষ্টি... তার পরে একটানা বৃষ্টি, সর্দি কাশি জ্বর । চারদিকে জল । খেলার মাঠ জলে ডুবে গেছে । বাড়ির বারান্দায় জল উঠে আসছে । ঘরে আটকে থাকার এই মনখারাপের সময়ে আমরা ভাবতাম আর কিছুদিন পরেই জল কমে যাবে, কাশ ফুটবে পুকুরপাড়ে দিঘির পাড়ে, নদীতীরে । কালকাসুন্দে ফুল হলুদ আলোয় মাতাবে চারদিক । নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । সেই ভেলায় চড়ে দুর্গা ঠাকুর আসবে । ভাবলেই মনের বিষাদ দূর হয়ে যেত ।

একদিন ভোরবেলা যেই রেডিয়োতে বেজে উঠত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ, আমরা এক ছুটে বেরিয়ে পড়তাম । মহালয়ায় চমকে উঠে দেখতাম পৃথিবী বদলে গেছে । এবার নতুন জামা, ঠাকুর, প্রসাদ আর হ‌ইহ‌ই । দলবেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখে বেড়াব যেমন, তেমন নিজের পাড়ায় পুজোর সঙ্গে সবাই মিলে মিশে থাকব । বড়দের কথায় কলাপাতা আনতে ছুটব । বেলুন কিনব । কলোনিপাড়ায় ঝগড়া কয়েকদিনের জন্য মুছে যাবে । সবাই এখন খুশি-খুশি । মায়েদের গলা এখন নরম । ভালোবাসা খেলা করছে হাওয়ায় । সত্যি সত্যি দুর্গা এসে আমাদের দিনগুলিকে আনন্দে ভরিয়ে দিতেন । বিজয়া দশমী প্রতিমা ভাসানের পরে সবাই বিষণ্ণ । ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে আমাদেরও খুব মন খারাপ হত। বাতাসে তখন ঠান্ডা মিশছে । কিছুদিন পরেই শীতকাল । আমরা আবার মনে মনে ভাবতাম যে শীত এলেই গাছিদাদু খেজুর গাছ কাটবে । সকালে কাঁপতে কাঁপতে আমরা খাব খেজুরের মিষ্টি রস । বড়দের প্রণাম করতে করতে আমি টের পেতাম শীতের সাতভাই কালীতলার মেলাকে ।

আজ যখন আমাদের গ্রামপ্রধান নিঝুম জায়গাটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মফস্বল শহরে পরিণত হয়েছে, চারদিকে বড় বড় পুজো, তখন আমার কিন্তু সেই দিনগুলোকে অনেক বেশি আপন বলে মনে হয় । কারণ সেই পুজোর সঙ্গে মিশে থাকত আমাদের বেঁচে থাকা । ঝকমকে পুজো থেকে আমি দূরে থেকেছি বরাবর । কোরোনার কারণে এ বছর পুজোর জাঁকজমক কমেছে অনেক । সেদিনের পুজোর সঙ্গে অনেক মিল পাচ্ছি । পাড়ার পুজোয় আবার দেখা করছে সবাই । মৃত্যুভয়, গৃহবন্দিত্বের পর চেনা মানুষের গন্ধের জন্য আবার আকুল হয়েছে মানুষ । এই আকুলতা ছাড়া দুর্গাপুজো বৃথা । ভালোবাসাই তো জীবনব্যাপী মূল উৎসব ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.