কলকাতা, 7 অক্টোবর : কুমারী পুজো ৷ অষ্টমীতে বিশেষ কিছু স্থানে এই পুজো দেখতে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা ৷ নবমীতে কুমারী পুজো হয় দর্জিপাড়া সর্বজনীনে । প্রথা মেনে ব্রাহ্মণের মেয়েদের নয় বরং প্রথা ভেঙে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন নাবালিকাদের পুজো করা হয়েছে এই মণ্ডপে । উদ্যোক্তাদের কথায়, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে এই উদ্যোগ নেওয়ার মূল কারণ, মানুষকে বোঝানো যে এই ধরনের মানুষদের সহানুভূতি নয়, সমানুভূতির সঙ্গে দেখা উচিত । প্রতিমারা আছে প্রতি মা'তেই ।
দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন থ্যালাসেমিয়া, ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত বা দৃষ্টিশক্তিহীন এমন নয় নাবালিকাকে কুমারী পুজোর আসনে বসিয়ে পুজো হল এই দর্জিপাড়ায় । কীভাবে এই ভাবনা ? দর্জিপাড়া সর্বজনীনের গণমাধ্যম সচিব সন্দীপ বোস বলেন, "আমরা প্রায় গত এক বছর ধরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি । এদের কাজের সঙ্গে আমরা মানসিকভাবে একাত্ম হয়েছি । তাঁরাই প্রথম আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই রকমভাবে যদি একটা পুজো করা যায় । আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটাতে সম্মতি জানিয়েছিলাম । কারণ, আমরা মনে করি কোনও মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হতে পারে, কিন্তু সে কখনও পিছিয়ে পড়তে পারে না । যার জন্য আমরা তাদেরকে সহানুভূতি নয়, সমানুভূতি, এই বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই নয় জন কুমারীকে আমরা পুজো দিয়েছি । প্রথা, ব্রাহ্মণের মেয়ে না হলে কুমারী পুজো হবে না । এই জাত, ধর্ম, বর্ণের উপরে উঠে আজ সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে আমরা সেই সমস্ত কুমারীদের তুলে এনেছি যারা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, যারা দৃষ্টিশক্তিহীন, যারা শ্রবণশক্তিহীন ৷ যারা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী, শারীরিক দিক থেকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, এই রকম নয়জন কুমারীকে আমরা এখানে পুজো দিয়েছি আজকে ।"
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার থেকে এই ন'জনকে আজ আনা হয়েছিল পুজো মণ্ডপে । সেই সংস্থার সম্পাদক সমিত সাহাকে এই অভিনব উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "আমরা আজকে নয় জন কুমারীকে মা দুর্গার সামনে কুমারী পুজোর আসনে নিয়ে এসেছি । যারা নানাভাবে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে । এদের মধ্যে কেউ কেউ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, কেউ দৃষ্টিহীনতাকে জয় করে এগিয়ে চলেছে, কেউ অটিস্টিক, কেউ বা ফুটপাতবাসী প্রান্তিক বালিকা । এইরকম নয় জন বালিকা আজকে কুমারী পুজোর আসনে বসেছেন । আমরা সাধারণত দেখি, কোনও বারোয়ারি দুর্গা পুজোর কুমারী পুজোতে হয়তো পাড়ার সম্ভ্রান্ত বাড়ির কুমারীরা পূজিতা হন । কিন্তু আমাদের এখানে আজ প্রথম এরকম একটা প্রান্তিক জায়গা থেকে বালিকাদের নিয়ে আসা হয়েছে । আমাদের উদ্দেশ্য তারা যাতে মায়ের আশীর্বাদে আগামী দিনে নারী শক্তির জাগরণে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলতে পারে । পাশাপাশি মানুষের মধ্যেও একটা বার্তা যাক যে, এই প্রান্তিক বালিকারা বা মানুষরা কেউ সামাজিকভাবে ব্রাত্য নয় । উৎসব সবার ।"

এই ধরনের একটা পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পেরে ওরা কী বলছে, এই প্রসঙ্গ উঠতেই সমিতবাবু বলেন, "ওদের অনুভূতি খুবই সুন্দর ছিল । দৃষ্টিহীন মেয়ে যারা ছিল তাদের অনেকেরই প্রায় চোখে জল এসে গেছে । বয়স্ক ঠাকুমা, কাকিমা তাদের এসে পায়ে প্রণাম করছেন, দক্ষিণা দিচ্ছেন, শাড়ি দিয়ে বরণ করছেন । তখন তাদের এটাই বক্তব্য, আমরা তো অন্ধ । অন্ধ মানে দয়া বা ভিক্ষা এই রকম একটা ধারণা আছে । একটা ব্যাপার থাকে যে, ও কী করবে । আর বাড়িতেও নিজের কাকিমা, মাসিমা, নিজের পরিজনও বলে, ও ঠাকুর দেখে কী করবে? ও তো অন্ধ-প্রতিবন্ধী, রাস্তায় নিয়ে বের হলে বিপদ । নিজের ঘরেই তারা ব্রাত্য । কিন্তু, আজ তারা এখানে পুজো মণ্ডপে সকলের মধ্যে মায়ের আশীর্বাদ পাচ্ছে, সকলের ভালোবাসা পেয়েছে এটা একটা বিরাট ব্যাপার ।"

দর্জিপাড়া সর্বজনীনের তরফে সুব্রত দেবপাল বলে, দর্জিপাড়া সর্বজনীন এবার 88তম বর্ষে পড়ল । গত আট বছর ধরে থিম পুজো করা হচ্ছে । এই বছর তাদের থিম 'স্বপ্নের উড়ান' । পরিবেশ সচেতনতার বার্তায় মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই থিমের মাধ্যমে । প্রতি বছরের মতো এই বছরও পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন সামগ্রী যেমন, বাঁশ, চট, কাগজ, ঝুড়ির মতোর জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুজো মণ্ডপটি ।