কলকাতা, 13 ডিসেম্বর: স্কুলছুটদের স্কুলে ফেরানো থেকে পড়াশোনার গুরুত্ব নিয়ে তাদের বাবা-মায়ের কাউন্সেলিং৷ ঝুপড়িতে শিক্ষার আলো পৌঁছতে নিত্যদিন লড়াই করে চলেছেন কর্পোরেট কর্তা স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ করোনার সময়কালে তাঁর এই কাজের হাতেখড়ি ৷ সেসময় রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার জন্য নিয়ে যাওয়া থেকে ওষুধের জোগান ৷ সবই করেছেন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির এই কর্তা। তবে করোনার পরও তাঁর কাজ থেমে থাকেনি ৷ তিনি এরপর করোনার জেরে বাবা-মাকে হারানো অনাথ শিশুদের পাশে দাঁড়ান ।
শুরু হয় স্নেহাশিসের নতুন লড়াই । কলকাতার বস্তি ও ঝুপড়ির ঘরে শিক্ষার আলো প্রবেশ করানোর দায়িত্ব নেন মাঝ বয়সি এই যুবক। করোনার সময় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল ৷ এর ফলে স্কুল থেকে মুখ ফিরিয়েছে বহু শিশুরা ৷ স্কুলছুট ওই সমস্ত শিশুদের ফের স্কুলে ফেরানোর পণ নেন স্নেহাশিস। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার আলোয় আসা কত প্রয়োজন, তা তাদের বাবা-মাকেও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বোঝাতে শুরু করেন তিনি ৷ পাশাপশি স্কুলে পড়ে কিন্তু দিশাহীন পড়ুয়াদের স্কুলছুটের প্রবণতা কমাতে উদ্যোগী হন এই কর্পোরেট কর্তা ।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ উদ্যোগে সমীক্ষা করেছেন তিনি ৷ সেখান থেকে স্কুলছুটদের নিয়ে বিজন সেতুর কাছে একটি সেন্টার করেছেন স্নেহাশিস ৷ সেখানেই কলকাতার বিভিন্ন এলাকার এমন ছেলে মেয়েদের ফের স্কুলমুখো হতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি । তাঁর সেন্টারে পড়ুয়ার সংখ্যা এখন 45 থেকে 50 জন । 2022 সালের শেষ থেকে এখনও পর্যন্ত তাদের মধ্যে 10 জন স্কুলছুটকে তিনি ফের বিদ্যালয়মুখী করেছেন ৷ তবে পরে তাদের মধ্যে দু'জন পড়াশোনা ছাড়ে ৷ পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝাতে বাকিদের কাউন্সেলিং দিচ্ছেন স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, দক্ষিণ 24 পরগনা ও কলকাতা স্কুলছুটদের নিয়ে কাজে করছেন তিনি ৷
শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানোর লড়াইটা কঠিন, তবু হাল ছাড়তে নারাজ স্নেহাশিস । এই মুহূর্তে তিনি কসবা টালিগঞ্জ এলাকার বেশ কিছু বস্তি ও ঝুপড়ি এলাকায় শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন । প্রান্তিক হতদরিদ্র পরিবারের কাছে পড়াশোনার থেকে শিশু বয়সে রোজগার করাটাই প্রাধান্য হয়ে দাঁড়ীয় । সেই বদ্ধমূল ধারণাকে ভেঙে তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে কাল ঘাম ঝরছে স্নেহাশিসের । তবে তাঁর লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর তিনি ৷ তাই তো এই কাজে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন স্ত্রীও ।
স্নেহাশিস বলেন, "করোনা পর বহু শিশু আর স্কুলের মুখ দেখেনি । আবার অনেক প্রান্তিক ঘরের ছেলে মেয়ে স্কুলে যায়, তবে তারা বুঝতে পারছে না পড়াশুনা করে কী হবে? তাদের পড়ার গুরুত্ব বোঝাচ্ছি । না হলে এরা বড় হয় সমাজে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছে । বিজন সেতুর কাছে একটি সেন্টার করে আমি বিভিন্ন এলাকার এমন ছেলে মেয়েদের স্কুলমুখো হতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি । 45-50 জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে সেখানে আমার । এর মধ্যে অনেককে ফের সফলভাবে স্কুলমুখী করা গিয়েছে । তাদের সঙ্গে বাবা মাকে বোঝানো হয়েছে পড়াশোনার গুরুত্বটা । আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে তাদোর । আবার অনেককে বুঝিয়ে স্কুল ছাড়া থেকে বিরত রাখা গিয়েছে ।"
তিনি জানান, তাঁর সেন্টারে ছেলে মেয়েদের নিজেদের মত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । যারা খেলতে ভালোবাসে তাদের খেলার মাধম্যে রান গুনতে বা গোল গুনতে যে অংক জানা প্রয়োজন, সেটা বোঝানো হয় । আবার মাঠে ঘাটে টুকটাক ইংরেজি শব্দ, যা আকছার ব্যবহার হয়, সেগুলো ঠিক করে উচ্চারণ করানো থেকে বানান শেখানোর মধ্য দিয়ে ইংরেজি শেখা ও জানার প্রয়োজনীয়তাটা বোঝানোর কাজ করছেন স্নেহাশিস ও তাঁর স্ত্রী ।
বিজ্ঞানের কর্মশালা করেন তাঁরা। এই কর্মকাণ্ড ব্যক্তি উদ্যোগেই শুরু । তবে সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পথে হাঁটার কথা ভাবছেন স্নেহাশিস । যাতে আরও বেশি সংখ্যায় ও বড় পরিসরে এই কাজ করা যায় । কেউ কেউ নিজে থেকে তাঁর এই কাজে আর্থিক সাহায্য করেন ৷ তবে সিংহভাগটাই নিজের মাসিক বেতন থেকে করেন এই কর্পোরেট কর্তা । স্কুল পাঠাতে এক দু'দিন নয়, টানা বছর খানেকের বেশি লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে । অবশেষে এসেছে সাফল্য । কিন্তু বিফলতার দিকও আছে বলে তিনি জানান ।
স্নেহাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, "বেশ কয়েকজনকে আমরা অনেক প্রশিক্ষণ দিয়েও স্কুলে ফেরাতে পারিনি । এখন লক্ষ্য এই না পারাটা যাতে ভবিষ্যতে কাটিয়ে উঠতে পারি । মাঝে মধ্যেই নতুন নতুন বস্তি এলাকায় সমীক্ষা চালাচ্ছি । বইখাতা কেনা থেকে আরও আনুষাঙ্গিক খরচ দেওয়াতে বহু পরিবার দেরিতে হলেও বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলে পাঠাচ্ছে । আমাকে নিয়মিত তাদের মধ্যে দেখে ইতিবাচক চিন্তা কাজ করছে পরিবারগুলির মধ্যে ।"
আরও পড়ুন: