সোনারপুর, 13 ফেব্রুয়ারি: সকাল থেকে বাজছিল বিসমিল্লার সানাই । রজনীগন্ধার মালায় ভরে উঠেছে প্যান্ডেল । আলোতে ঝলমল করছে চারিদিক । প্রস্তুত বিবাহ বাসর । অতিথি আপ্যায়ন আর পাঁচটা বিয়ে বাড়িকে ছাপিয়ে গিয়েছে । সে তো আর পাঁচটা বিয়েতেও হয় । তাহলে আর ঘটা করে বলার কী আছে ?
কারণ এই বিয়ের পাত্রপাত্রী যে বিশেষ ৷ তারা দুই 'পজিটিভ' মানুষ । একদিকে তাঁরা যেমন মন থেকে 'পজিটিভ' তেমনই শরীরে বয়ে চলেছে এইচআইভি পজিটিভ । আর তাঁদের বিয়েতে কোনরকম কার্পণ্য করেননি উদ্যোক্তারা । কারণ তারাও মানসিকভাবে পজিটিভ । অগ্নিসাক্ষী রেখে মালা বদল করেন ও সাতপাক ঘোরেন পাত্রপাত্রী । বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করেন মহিলা পুরোহিত । আর তাতেই গাঁটছড়া বাঁধলেন দুটি নিষ্পাপ মনের মানুষ । আর তাকে সম্মতি দিল সমাজ ।
দক্ষিণ 24 পরগনার সোনারপুরের গোবিন্দপুরে 'আনন্দ ঘর' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এইচআইভি পজিটিভ শিশুদের নিয়ে । যে সমস্ত পিতামাতা এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বাচ্চাদেরকে এই হোমে রেখে বড় করা হয় । সেরকমভাবেই এই হোমে উপস্থিত হয়েছিল মেদিনীপুরের সুনিতা যাদব । ছোটবেলা থেকেই বাবামাকে হারিয়ে এই হোম থেকেই পড়াশোনা করে তিনি । 'আনন্দঘর' হোম তাঁকে শৈশব থেকে কৈশোরে এবং যৌবনে পা-রাখতে সাহায্য করেছে ।
বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি 'কাফে পজিটিভ' নামে একটি কফি শপে কর্মরত । কিন্তু প্রতিমাসে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে যেতে হয় অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল ভাইরাল থেরাপি চিকিৎসা নিতে । এই মেডিক্যাল কলেজে তাঁর আলাপ হয়েছিল সৌমিত্র গায়েন নামে উত্তর 24 পরগনার সন্দেশখালির এক যুবকের সঙ্গে । ছোটবেলায় বিড়ালের কামড়ের ইনজেকশন নিতে গিয়ে সিরিঞ্জ থেকে আক্রান্ত হন এইচআইভি পজিটিভে । সৌমিত্রর সঙ্গে প্রথম দেখাতেই মন দেওয়া নেওয়া । ঈশ্বর হয়তো চেয়েছিলেন তাদের এই সম্পর্ক পরিণতি পাক । আর তাই সেই সম্পর্ক গড়াল বিয়েতে । রবিবার সন্ধ্যায় এল শুভক্ষণ ৷ সম্পন্ন হল বিয়ে । যে বিয়ে আর পাঁচটা অন্য সব বিয়েকে মলিন করে দিয়েছে সম্পর্কের ভালোবাসায় ।
দুই এইচআইভি পজিটিভ রোগী হওয়ার সত্বেও যেভাবে তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সত্যি অকল্পনীয় । আর তাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিতে কোন অংশেই খামতি রাখেননি উদ্যোক্তা কাকুরা । বিয়ের কার্ড ছাপানো থেকে অতিথি আপ্যায়ন, সবই হয়েছে নিয়ম মেনে । তবে এ বিষয়ে সব থেকে উদ্যোগী হয়েছেন যে মানুষটি, তিনি হলেন কলকাতা পৌরসভার 28 নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তী । এ বিষয়ে অয়নবাবু বলেন, "সমাজে এইচআইভি মানুষদের এখনও অনেকে খারাপ চোখে দেখে । আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই । সঠিক চিকিৎসা দিলে এবং সমাজের মানুষের ভালো ব্যবহার পেলে এইচআইভি পজিটিভরা যে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা আমরা বোঝাতে চেয়েছি । তারা সমাজে কোথাও যেন কোনওরকম প্রতিবন্ধিকতার শিকার না-হন ৷ সেটাও আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে।"
এই বিয়ের অনুষ্ঠানে পাত্র পক্ষের আংটি থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা সবই করেছেন সমাজের বেশ কিছু সহৃদয় ব্যক্তি । আর তারাই উদ্যোগী হয়েছেন এই বিয়েকে আরও বেশি মঙ্গলময় করে তুলতে । স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে মৃণাল বিশ্বাস বলেন, "সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি পেলে দু'জন পজিটিভ এইচআইভি পিতামাতার থেকেও সুস্থ সন্তান পাওয়া সম্ভব । আমরা চাই সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ এগিয়ে এসে এইচআইভি পজিটিভ শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণ করুক । তার কারণ যে শিশুরা এইচআইভি পজিটিভ হয়েছে, তাতে তাদের কোনও দোষ নেই ৷ তারা শুধুমাত্র এই রোগকে বহন করে চলেছে কিছু মানুষের ভুলের ফল হিসাবে ।"
আরও পড়ুন: থানায় কর্মসূত্রে আলাপ, সেখানেই শুভ পরিণয় সিভিক ভল্যান্টিয়ার রাণু-স্বরূপের