শিলিগুড়ি, 18 জুলাই : কলকাতা বিমানবন্দরের ভিতরেই গোঁ ধরেছেন এক যুবক ৷ তাঁকে কোয়ারানটিন সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে, এটাই তাঁর দাবি ৷ নাহলে তিনি বিমানবন্দর থেকে বের হবেন না ৷ কিন্তু, শুধু শুধু কেন তাঁকে কোয়ারানটিন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না আধিকারিকরা ৷ একাধিকবার অনুরোধের পরও লাভ না হওয়ায় পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে আধিকারিকদের দেন ৷ তা দেখে উপস্থিত সকলের চক্ষু চড়কগাছ ৷ কাগজটি আসলে কোরোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ৷ তাতে লেখা, ওই যুবক কোরোনা আক্রান্ত ৷ তৎক্ষণাৎ তাঁকে রাজারহাটের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় ৷ কোরোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি দিল্লি থেকে গুয়াহাটি হয়ে কলকাতা বিমানবন্দর পৌঁছান ৷ ঘটনার পর থেকেই উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন ৷ দিল্লি ও গুয়াহাটি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যবস্থার অভিযোগ উঠেছে ৷ শুধু কি এই একজনই ? এরকমভাবে অনেকেই ফিরছেন রাজ্যে ৷
এই মাসের শুরুতেই রাজ্য সরকারের তরফে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রকে ৷ তাতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, 6 জুলাই থেকে দেশের মোট ছয়টি শহর থেকে কোনও বিমান যেন পশ্চিমবঙ্গে না প্রবেশ করে ৷ যে শহরগুলির নাম এই তালিকায় রয়েছে সেগুলি হল দিল্লি, মুম্বই, পুনে, নাগপুর, চেন্নাই ও আহমেদাবাদ ৷ 19 জুলাই পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে বলেও জানানো হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে ৷ গতকাল এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ 31 জুলাই পর্যন্ত বাড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ৷ নবান্নের অনুরোধে অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রক এই সিদ্ধান্ত নেয় ৷
কিন্তু, কতটা মানা হচ্ছে এই নিয়ম ? তাহলে কি সত্যিই এই রাজ্যগুলি থেকে কেউ পশ্চিমবঙ্গে বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ এই রাজ্যগুলিতে যাতায়াত করতে পারছেন না ? 14 জুলাইয়ের এই ঘটনার পর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কলকাতায় ওই ছয় রাজ্য থেকে বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও অনেকেই রাজ্যে ফিরছেন বা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যগুলিতে যাচ্ছেন ৷ কিন্তু, কীভাবে ? হিসেব বলছে, অনেকেই দিল্লি থেকে গুয়াহাটি হয়ে কলকাতা আসছেন ৷ আবার অনেকে দিল্লি থেকে বাগডোগরা হয়ে কলকাতা আসছেন ৷ একইভাবে কলকাতা থেকে বাগডোগরা বা গুয়াহাটি হয়ে দিল্লি যাচ্ছেন ৷ এভাবে বাগডোগরায় এসে পৌঁছানোর পরই যাত্রীরা আর আন্তঃরাজ্য চলাচলকারী যাত্রী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন না ৷ বাগডোগরা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় তিনি রাজ্যের অভ্যন্তরে চলাচলকারী যাত্রী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন ৷
স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী, উল্লেখিত ছয় রাজ্য থেকে এরাজ্যে এলে 14দিনের হোম কোয়ারানটিনে থাকা বাধ্যতামূলক ৷ কিন্তু, রাজ্যের অভ্যন্তরে যাতায়াত করায় সেই বাধ্যবাধকতা আর থাকছে না ৷ কারণ, কলকাতা বিমানবন্দরে দেখা হচ্ছে তিনি বাগডোগরা থেকে এসেছেন অর্থাৎ রাজ্যের মধ্যেই যাতায়াত করছেন ৷ এভাবে রাজ্য সরকারের বিধিনিষেধের মধ্যেও ফাঁক খুঁজে চলছে ভিন রাজ্য থেকে রাজ্যে ফেরার বা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার হিড়িক ৷ বহু পদক্ষেপ নেওয়ার পরও তাতে সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় আদতে কিছুই কাজে আসছে না ৷ লকডাউন ঘিরে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলি হয়ে যাচ্ছে বেকার ৷ বাম-BJP-র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ৷ বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, বাস্তব পরিস্থিতি যদি এটাই হয়, তাহলে লাভ কোথায় হচ্ছে ৷
শিলিগুড়ির পৌরনিগমের প্রশাসক বোর্ডের সদস্য শংকর ঘোষ বলেন, "আসলে সবটাই সঠিক পরিকল্পনার অভাব ৷ মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাতে হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাচ্ছেন রাজ্যের আধিকারিকরা ৷ যদি সত্যিই দেশের ওই ছয়টি বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হত, তাহলে শুধু কলকাতা নয়, বাগডোগরার ক্ষেত্রেও একই বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা উচিত ছিল ৷ পাশাপাশি, দেশের অন্য বিমানবন্দরগুলি থেকে ভায়া হয়ে যাঁরা এরাজ্যে আসছেন, সঠিক পরিকল্পনা করে সেই যাত্রীদের চিহ্নিতকরণ ও তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কাজ করা প্রয়োজন ছিল ৷ কিন্তু তা হচ্ছে না ৷"
অনেকেই যে অন্য রাজ্য থেকে বাগডোগরায় বিমান পালটে কলকাতা যাচ্ছেন তা মনে নেন বাগডোগরা বিমানবন্দরের অধিকর্তা সুব্রমনি পি ৷ তিনি বলেন, "দেশের যে কয়েকটি বিমানবন্দরের সঙ্গে সরাসরি কলকাতার যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন রাখা হয়েছে, সেই বিমানবন্দরগুলি থেকে যাত্রীরা বাগডোগরা এসে বিমান পালটে অনেকেই কলকাতা যাচ্ছেন ৷ আবার অনেকে কলকাতা থেকে বাগডোগরা হয়ে অন্য রাজ্যে যাচ্ছেন ৷" বাগডোগরা থেকে বিমান চলাচলে বিধিনিষেধ জারি করতে চেয়ে রাজ্যের তরফে কোনও অনুরোধ করা হয়নি বলেও জানান তিনি ৷ তাই প্রতিদিনই দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই-সহ প্রতিটি বিমানবন্দর থেকে বাগডোগরা আসছেন ৷
রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করেছেন দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তাও ৷ তিনি বলেন, "পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে ৷ তাই বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো হচ্ছে ৷"
অন্যদিকে, এই বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমের বক্তব্য জানতে চেয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় । তিনি বৈঠকে থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি । তবে, রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তীর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "মানুষকে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে । আমাদের সকলের ভালোর জন্য প্রত্যেককেই কিছু কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে ।" এ দিকে স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, অবাধ যাওয়া-আসা চালু থাকলে সংক্রমণ অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়বে । এটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চেষ্টা চলছে ।