জলপাইগুড়ি, 4 অগস্ট: দুই দাদা ও বাবা কাজ করেন ভিনরাজ্যে ৷ তাই বাড়ির ছোট ছেলেও উপার্জনের তাগিদে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করার জেদ ধরেছিলেন ৷ কিন্তু সেই যাওয়াই তাঁর কাল হল ৷ গত 2 জুন ওড়িশার বালাসোরে যে রেল দুর্ঘটনা হয়, তাতেই প্রাণ হারাতে হল কোচবিহারের দিনহাটার ছোট আটিয়াবাড়ির বাসিন্দা বিপুল রায়কে ৷ যার জেরে বিপুলের বাবা শিবকান্ত রায় শপথ নিলেন যে তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ আর কোনোদিন ভিনরাজ্যে কাজে যাবেন না ৷
ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু: গত 2 জুন ওড়িশার বালাসোরের কাছে বাহানাগা বাজার স্টেশনের অদূরে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে ধাক্কা মারে মালগাড়িতে ৷ তার জেরে ওই ট্রেন লাইনচ্যূত হয় ৷ তার অভিঘাতে উলটোদিক থেকে আসা হাওড়াগামী হামসফর এক্সপ্রেসের কয়েকটি কামরাও লাইনচ্যূত হয় ৷ সেই হামসফর এক্সপ্রেসেই ছিলেন বিপুল রায়৷ দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন ৷ পরিবারের সদস্যরা প্রায় মাসখানেক ধরে হাসপাতালে ঘুরেছেন ৷ কোথাও বিপুলের সন্ধান মেলেনি ৷
পরিবারের দাবি, তাঁকে খুঁজে পাওয়ার আশা একেবারে ছেড়েই দেওয়া হয়েছিল ৷ হঠাৎ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে একটি মৃতদেহের সঙ্গে শিবকান্ত রায়ের ডিএনএ মিলেছে ৷ তাই সেটিই বিপুলের মৃতদেহ ৷ পরের পরিবারের তরফে গিয়ে দেহ শনাক্ত করা হয় ৷ রেলের তরফে দেহ তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে ৷ রেলের তরফে 10 লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্যও করা হয় বিপুলের পরিবারকে ৷ কিন্তু টাকার বদলে যদি 22 বছরের তরতাজা ছেলেটাকে জীবিত ফিরে পেতেন ! আক্ষেপ ঝরে পড়ে শিবকান্ত রায়ের গলায় ৷
আরও পড়ুন: করমণ্ডল দুর্ঘটনার 30 দিন পর কাকদ্বীপে দেহ ফিরল নিখোঁজ দুই যাত্রীর
পরিযায়ী শ্রমিক বিপুল রায়ের মর্মান্তিক পরিণতি: তিনি অরুণাচল প্রদেশে মিস্ত্রির কাজ করতেন ৷ দুই ছেলে তাপস ও স্বপন তাঁর সঙ্গেই সেখানে কাজ করেন ৷ বিপুল বরাবর বাড়িতেই ছিলেন ৷ কিন্তু মাস কয়েক আগে তিনিও বাইরের কাজে যাওয়ার জেদ ধরেন ৷ শিবকান্ত রায় বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার মাত্র 20 দিন আগে বিপুল তিরুপতিতে গিয়েছিল কাজ করতে । কিন্তু সেখানের আবহাওয়া তার পছন্দ ছিল না । তাই সে থাকতে রাজি হয়নি । তিরুপতি থেকে হামসফর এক্সপ্রেসে করে বাড়ি ফিরছিল ।’’
বিপুলের বাইক রয়েছে ৷ কিস্তিতে কেনা বাইকের টাকা এখনও পরিশোধ হয়নি ৷ তাই ওই টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত বিপুলকে তিরুপতিতে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন শিবকান্ত ৷ কিন্তু বিপুল সেকথা কানে তোলেননি ৷ বরং ফিরে আসার জেদে অনড় ছিল ৷ শিবকান্তের কথায়, বাড়ি থেকে তাঁর ফেরার টাকা পাঠানো হয় ৷ সেই টাকায় ফেরার টিকিট কেটে প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে হামসফর এক্সপ্রেসে ওঠেন ৷ প্রতিবেশী ওই যুবক দুর্ঘটনায় আহত হন ৷ পরে তাঁকে হাসপাতালে পাওয়া যায় ৷ কিন্তু বিপুল !
ভিনরাজ্যে কাজে না যাওয়ার শপথ নিহতের বাবার: শিবকান্তর চোখে তখন শুধুই শূন্যতা ৷ ছেলের দুর্ঘটনার খবর পেয়েই অরুণাচল থেকে ফিরে আসেন তিনি ৷ তার পর ছেলের খোঁজে ওড়িশার প্রায় সব হাসপাতাল-মর্গ ঘুরেছেন ৷ প্রায় দু’মাস পর ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তিনি বলছেন, ‘‘আমি আর কোনোদিন ভিনরাজ্যে কাজে যাব না । এমনকি আর দুই ছেলেকেও কাজে যেতে দেব না । বেঁচে থাকলে অনেক কিছু করতে পারব ৷’’
আরও পড়ুন: ট্রেন দুর্ঘটনার জের, ভিনরাজ্যে কাজ করতে যেতে নারাজ পরিযায়ী শ্রমিকরা
কিন্তু কী করবেন ? পেট তো চালাতে হবে ! এক্ষেত্রে তাঁর কাছে একমাত্র আশার আলো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ৷ মুখ্যমন্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিলেন সেই সময় ৷ তাই শিবকান্ত দেখা করতে চান কোচবিহারের জেলাশাসকের সঙ্গে৷ যদি একটা চাকরি মেলে !