বোলপুর, 7 অক্টোবর: গরুপাচার কাণ্ডে (Cattle Smuggling Scam) অভিযুক্ত বীরভূমে তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal) ৷ আপাতত তিনি বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন ৷ শুক্রবারই তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করেছে সিবিআই (CBI) ৷ তদন্তকারীদের পেশ করা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁর শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল ৷ তার পরও তিনিই বীরভূমের রাজনীতিতে থেকে গিয়েছেন 'বেতাজ বাদশা' হিসেবে ৷ সেই কারণে এখনও তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে ৷
যদিও বীরভূমের আনাচে-কানাচে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, অনুব্রত মণ্ডল সম্পর্কে নানা তথ্য ৷ সেগুলির বেশিরভাগটাই অভিযোগ ৷ বীরভূমের বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলছেন, গরুপাচার নিয়ে সিবিআই তদন্ত করছে, তাই এই নিয়ে হইচই হচ্ছে ৷ কিন্তু অনুব্রতর ‘রাজত্বে’ দুর্নীতি বীরভূমের রাজনীতি ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে ৷ সে আবাস যোজনার বাড়ির অর্থ দেওয়া থেকে রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদারির বরাত, সব কাজই হত শাসক দলকে ‘খুশি’ করার বিনিময়ে ৷ তৃণমূলের সভা-সমাবেশে হাজিরার নিরিখেই একশো দিনের কাজ পেতেন শ্রমিকরা ৷ আর পুরোটাই কেষ্ট মণ্ডলের অঙ্গুলিহেলনেই চলত বলে অভিযোগ ৷
আরও পড়ুন : গরু পাচার মামলায় অনুব্রতর নামে চতুর্থ চার্জশিট পেশ সিবিআইয়ের
বোলপুরের বাসিন্দারা জানান, সবাই সব জানে ৷ কিন্তু বলার সাহস কারও নেই ৷ কারণ, তাহলেই ‘ফল’ ভুগতে হবে ৷ বিরোধী স্বরকে চাপা দিতে পুলিশকে ব্যবহার নাকি অনুব্রতর জন্য জলভাত ছিল ! কাকে কী কেস দিতে হবে, তা নাকি তিনিই বলে দিতেন পুলিশকে ! তাছাড়া কোন থানার ওসি কে হবেন, অপছন্দের পুলিশ আধিকারিকদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশও অনুব্রতই দিতেন বলে অভিযোগ ৷
বীরভূমের একটি থানার ওসি নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বললেন, "অনুব্রত মণ্ডল রুষ্ট হওয়ায় আমাকে ওসি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ এসপি স্যর চাইতেন আমি ফের ওসি হই ৷ কিন্তু, তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না ৷ এক সিনিয়র অফিসারের কথা মতো আমি বোলপুরে অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে কথা বলি ৷ তাঁর মানভঞ্জন হয় ৷ দীর্ঘ এক বছর পর আমি ফের ওসি হই ৷ সেই দিনগুলি আজও মনে পড়ে ।"
বীরভূমের রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত, তাঁরা বলছেন, পুরো জেলা প্রশাসনই বোলপুরের নিচুপট্টির তৃণমূল কংগ্রেসের অফিস থেকেই চলত ৷ সেখানেই বসেই ঠিক হত যে কোন রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদারি কাকে দেওয়া হবে, কোন বালিঘাটের টেন্ডার কে পাবে, আবাস যোজনায় কে বাড়ি পাবেন, কোথায় ফ্ল্যাট তৈরি হবে, কোথায় নর্দমা তৈরি হবে ৷
আরও পড়ুন : বোলপুর পৌরসভায় বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করাতে অনুদান! হাইকোর্টের মামলা অনুব্রতর বিরুদ্ধে অভিযোগ
এর জেরে উন্নয়নের কাজ বারবার বাধা পেয়েছে বলে অভিযোগ ৷ সেই অভিযোগই তুললেন বিজেপির (BJP) জাতীয় সম্পাদক তথা বোলপুরের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরা (Anupam Hazra) ৷ তাঁর দাবি, ‘‘আমি সাংসদ থাকাকালীন নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারিনি ৷ কোথাও উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ করব ভাবলেই আমাকে থামিয়ে দেওয়া হত ৷ জেলাশাসক পর্যন্ত অনুব্রত মণ্ডলের কথায় চলতেন ৷ বীরভূমে কোন বিধায়ক, সাংসদের গুরুত্ব নেই, নিজের ইচ্ছেয় তাঁরা কাজ করতে পারেন না । অনুব্রতর ইচ্ছেতেই সব কাজ করতে হবে, না-করলেই দল বিরোধী তকমা দিয়ে দেবে । এটাই হয়ে এসেছে এতকাল ।"
অভিযোগ, এই পুরো দুর্নীতি চক্রে বেআইনিভাবে অর্থের লেনদেনও হত ৷ আবাস যোজনার বাড়ি পেতে হলে, রাস্তা নির্মাণের ঠিকা পেতে হলে, বালিঘাটের টেন্ডার পেতে হলে কাটমানি দিতে হয় ৷ এমনকী, প্রশাসনের কাছ থেকে বিভিন্ন শংসাপত্র পেতে হলেও কাটমানি দিতে হয় বলে অভিযোগ ৷ যা পঞ্চায়েত থেকে ধাপে ধাপে জেলাস্তরে চলে আসত ৷ বিরোধীদের অভিযোগ, ওই টাকার বেশিরভাগ অংশ পেতেন অনুব্রতই ৷ আর তাঁর হাত ঘুরে সেই অর্থের একটা অংশ চলে যেত তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে ৷
আরও পড়ুন : দাতব্য সংস্থাকে দান করা জমির মালিক এখন অনুব্রতর মেয়ের কোম্পানি !
অভিযোগের শেষ এখানেই নয় ৷ জেলার বাসিন্দাদের একাংশ আবার উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছেন বীরভূমের দুর্নীতি সম্পর্কে ৷ কী সেই উদাহরণ ? তাঁরা বলছেন, অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে এক ঠিকাদারের মনোমালিন্যের জেরে বোলপুর থেকে সিঙ্গি যাওয়ার রাস্তা নির্মাণ দীর্ঘদিন থমকে ছিল । এখনও বোলপুর থেকে নানুর যাওয়ার রাস্তার কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে ।
দেউচা-পাচামিতে কয়লাখনির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, তা বন্ধ করতে অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশেই পুলিশ-প্রশাসন সক্রিয় হয় বলে অভিযোগ ৷ প্রথমে অর্থের প্রলোভন ৷ না-মানলে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করানোর অভিযোগও রয়েছে ৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও মিথ্যা গাঁজা-কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও অনেক ৷
যা নিয়ে বোলপুরের প্রাক্তন সাংসদ সিপিএমের রামচন্দ্র ডোম বলছেন, "এই জেলায় গত 10 বছরের দুর্নীতি মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । অনুব্রতর ত্রাসের রাজত্বে মুখ খুলতে পারেননি কেউই ৷ পুলিশ-প্রশাসনের লোকজন পর্যন্ত নিজের ইচ্ছেয় কাজ করতে পারেনি ৷ ক্ষমতায় অন্ধ অনুব্রত সময়কালে সরকারি নিয়ম, সাংবিধানিক নিয়মের কোনও বালাই ছিল না ৷ সবই দলের পার্টি অফিস থেকে ঠিক হয়ে এসেছে ।"
যদিও অনুব্রতর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগকেই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে তৃণমূল ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সরকারের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের অন্যতম নেতা চন্দ্রনাথ সিনহা বললেন, "সিপিএমের অত্যাচার থেকে অনুব্রতর নেতৃত্বে এই 'বামদুর্গ বীরভূমে' ঘাসফুল ফুটেছে ৷ গত 11 বছরের গ্রামে গ্রামে উন্নয়ন পৌঁছে গিয়েছে । মানুষ তার পরিষেবা পেয়েছে । বিরোধীদের কাজই কুৎসা রটানো । বীরভূম আজ ভালো আছে । আরও উন্নয়ন হবে, ভালো থাকবে বীরভূমবাসী ।"
আরও পড়ুন : জমি-পুকুর-মিল কেনায় অনুব্রতর ওয়ার্ডে তিন জনের বাড়িতে সিবিআই