শান্তিনিকেতন, 18 আগস্ট : পৌষমেলার মাঠে প্রাচীর দেওয়াকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের পর আজ সুনসান বিশ্বভারতী । ঘটনায় দুবরাজপুরের তৃণমূল বিধায়ক নরেশচন্দ্র বাউড়িসহ বেশ কয়েকজনের নামে শান্তিনিকেতন থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফে । নাম রয়েছে ব্যবসায়ী সমিতির কর্তাব্যক্তিদের। এখনও পর্যন্ত আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । বন্ধ রয়েছে প্রাচীর নির্মাণের কাজ । এদিকে এবিষয়ে আলোচনার জন্য আগামীকাল জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর তত্ত্বাবধানে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে ।
ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলার মাঠ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরেই উত্তাল বিশ্বভারতী চত্বর । প্রাচীর দেওয়ার বিরোধিতা করে আগেই পথে নেমেছেন বিশ্বভারতীর পড়ুয়া, আশ্রমিক, রবীন্দ্র অনুরাগীদের একাংশ । অভিযোগ, বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে অচলায়তনে পরিণত করা হচ্ছে ৷ বিষয়টি রবীন্দ্র আদর্শের পরিপন্থী ৷ তাদের দাবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শে গড়ে ওঠা বিশ্বভারতীকে অচলায়তনে পরিণত করা যাবে না । তার পরেও নির্মাণকাজ চলতে থাকায় বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতি এসে কাজে বাধা দেয় । বিশ্বভারতীর ঠিকাদারের সঙ্গে শুরু হয় বচসা । বচসার পর ঠিকাদারকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ ওঠে । বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ । এই ঘটনার পর রবিবার বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একাংশ কর্মী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা একটি মিছিল করে শান্তিনিকেতন থানার সামনে জড়ো হন । মিছিলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে আসার অভিযোগ ওঠে উপাচার্যের বিরুদ্ধে । উপাচার্যর নির্দেশে ফের শুরু হয় প্রাচীর নির্মাণের কাজ । পৌষমেলার মাঠে অস্থায়ী ক্যাম্প অফিস তৈরি করে রাতারাতি চলছিল নির্মাণকাজ । গতকাল বোলপুর-শান্তিনিকেতনের কয়েক হাজার মানুষ শান্তিনিকেতন থানার সামনে জড়ো হয়ে নির্মাণ সামগ্রী ভেঙে দেয় । JCB মেশিন এনে ভেঙে দেওয়া হয় কংক্রিটের গেট । ভাঙচুর চালানো হয় বিশ্বভারতীর অস্থায়ী ক্যাম্প অফিসে । অভিযোগ, লুটপাট করা হয় নির্মাণ সামগ্রীও ।
বিষয়টি নিয়ে সুর চড়ান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় । বিশ্বভারতীতে ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকে সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগ তোলেন ৷ অন্যদিকে রাজ্যপালের মন্তব্যের থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে গতকাল সাংবাদিক বৈঠকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ বলেন, "আমি চাই না ওখানে কোনও নির্মাণকাজ হোক ৷" ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান, বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী, BJP-র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা । । রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে বিরোধী শিবির । CPI(M) নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "রবীন্দ্রনাথের নামঙ্কিত বিশ্বভারতীর সর্বনাশ করতে এরা উঠেপড়ে লেগেছে ৷ উপাচার্য কারও সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করেন না । সব সিদ্ধান্ত নিজে নিজেই ঠিক করেন ।"
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান বলেন, "শান্তিনিকেতন সারা বিশ্বের কাছে একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্র ৷ সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে তা সত্যিই নিন্দনীয় ৷ শাসকদল বলছে তারা এটা করেনি ৷ কিন্তু শাসকদলের প্রেরণা, ইন্ধন না থাকলে এই ঘটনা ঘটত না ৷ পুলিশের নাকের উপর দিয়ে বুলডোজ়ার নিয়ে আসা হয়েছে ৷ মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন না ? রাজ্য সরকার যদি এই ঘটনার জন্য দায়ি না থাকে তাহলে অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হোক ৷ তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক ৷ তাহলে বুঝব এই ঘটনার জন্য রাজ্য সরকার দায়ি না ৷" পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ ঠাকুর পরিবারের অন্যতম সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুর ৷ বলেন, " বিশ্বভারতীজুড়ে রবীন্দ্র আদর্শ বিরোধী কাজকর্ম চলছে ৷ তাই রবীন্দ্র আদর্শের কথা না বলাই ভালো ৷"
কংগ্রেস, CPI(M)- এর পাশাপাশি এই ঘটনার সমালোচনা করে BJP ৷ দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেন, "বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তার পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত আছে । মুখ্যমন্ত্রীর ইন্ধনে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নিজের জমিতে পাঁচিল দিতে পারছে না । মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক থেকে এটা পরিষ্কার যে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তার পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত আছে ।" গতকাল থানার সামনে এই ঘটনা ঘটলেও ঘটনাস্থানে কোনও পুলিশকর্মীকে দেখা যায়নি । কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ঘটনার সময় পুলিশকে জানানো হলেও পুলিশ আসেনি । পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় । এই মর্মে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিক অনির্বাণ সরকার । যদিও, পুলিশ সুপার শ্যাম সিং জানান, ঘটনার প্রেক্ষিতে আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই বিষয়ে আজ মন্তব্য করেছেন BJP-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও । ঘটনার পিছনে রাজ্যের শাসক দলই দায়ি বলে অভিযোগ তোলেন তিনি । বলেন, "স্থানীয় লোকজন গতকালের কাজে যুক্ত থাকতে পারেন । জমি মাফিয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জমি দখল করেছে । বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের জমিকে সুরক্ষিত করার অধিকার আছে । কিন্তু গতকাল যা করা হয়েছে গায়ের জোরে, তা মোটেই নৈতিক কাজ নয় । কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষা দিতে চায় না সরকার । তার বিরোধিতা করাই রাজ্য সরকারের কাজ হয়েছে ।"
আগামীকালের বৈঠকে থাকবেন পুলিশ সুপার শ্যাম সিং, বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা, পড়ুয়ারা । বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে । গম্ভীর পরিস্থিতি সামাল দিতেই এই বৈঠক । বৈঠকে কী আলোচনা হয় সেদিকেই এখন নজর সব মহলের ।