কলকাতা, 15 এপ্রিল: দহন জ্বালার মাঝেই চৈত্র অবসানে হয় নতুন বছরের আবাহন ৷ বাঙালি তার মতো করে বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনে উৎসবে মেতে ওঠে ৷ মেতে ওঠে কলকাতা ময়দানও ৷ সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবলের আবাহনে কলকাতা ময়দানও পালন করে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে ৷ আজকের দিনে কলকাতা ময়দানের অন্যতম প্রথা বারপুজো ৷
একটা সময় পর্যন্ত নববর্ষে ময়দানের বারপুজো দুই প্রধান ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন তা প্রায় সমস্ত ক্লাবে হয়ে থাকে ৷ কবে থেকে এই বারপুজো শুরু হয়েছিল ? তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না ৷ সম্ভবত ছয়ের দশকের শেষভাগে বারপুজো শুরু হয়েছিল ৷ ফুটবল পাগল বাঙালির জীবনে বারপুজোর মাহাত্ম্য বেড়েছে দলবদলের সময় থেকে ৷ ছয় ও সাতের দশকে চৈত্র মাসের আগে শেষ হত দলবদল ৷ মরশুমের চরিত্রটা আজকের মতো ছিল না ৷ সেই সময় ক্লাবে নতুন মরশুমের অনুশীলন শুরু হত বাংলা বছরের প্রথম দিনে। সেদিন নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণা করা হত ৷ বার ছুঁয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে সংকল্প নিতেন নতুন মরশুমে দলের অধিনায়ক ৷
বছরের প্রথম দিনে ক্লাব তাঁবুতে পুজোর পর সদস্য, সমর্থকদের লাইন দিয়ে লুচি, বোঁদে, পান্তুয়ার খাওয়ার ঢল নামার ট্র্যাডিশন ছিল মোহনবাগানে ৷ প্রাক্তন ফুটবলাররা ক্লাব লনে বসে আড্ডা দিতেন ৷ নতুন দল নিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা জানাতেন ৷ এর ফলে ফুটবলাররাও উদ্বুদ্ধ হতেন ৷ এককথায় পুরো সকালটা ছিল মিলন মেলা ৷ ইস্টবেঙ্গলে বারপুজো হলেও, প্রথমদিকে খাওয়া-দাওয়ার জাঁকজমক ছিল না ৷ তবে, এখন পরিস্থিতি আলাদা ৷
এখন প্রশ্ন কোন দেবতার পুজো হয় বারপুজোয় ? কী মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় ? এই প্রশ্নের উত্তরে পরিসংখ্যানবিদ কুশল চক্রবর্তী সঠিক কিছু বলতে পারেননি ৷ প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ময়দানের খেলার পরিসংখ্যান রেখেছেন তিনি। কিন্তু, বারপুজোয় কোন দেবতা পূজিত হন ? তা তাঁর কাছেও ধোঁয়াশার ৷ কর্মকর্তারাও না কি এই ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন ৷ কোন পুরোহিত পুজো করবেন সেটাও গোপন রাখার চেষ্টা হয় ৷
সাধারণভাবে বারপুজো কলকাতা ময়দান ছাড়া বিশ্বের কোনও প্রান্তে হয় বলে শোনা যায়নি ৷ কীভাবে এই পুজো শুরু হয়েছিল ? সেই ইতিহাসও অজানাই থেকে গিয়েছে ৷ এ প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিতদের কাছে নানান ধরনের উত্তর পাওয়া গিয়েছে ৷ কেউ বলেছেন, লক্ষ্মী এবং নারায়ণের মন্ত্রে পুজো হয় ৷ কেউ বলছেন, বিশ্বকর্মা পুজোর মন্ত্র ৷ আশ্চর্যের বিষয় কোনও শালগ্রাম শিলা বা ঘট নয়, পুজো করা হয় একটি বলকে ৷ কারণ, বল নিজেদের গোলের বদলে প্রতিপক্ষের গোলে আছড়ে পড়ুক এটাই তো কামনা ৷
আসলে ধর্মীয় আচার এখানে গৌণ ৷ মুখ্য হল, মরশুমের শুরুতে দলের অধিনায়ক এবং অন্যান্য ফুটবলাদের সঙ্গে সমর্থকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া ৷ কারণ, কলকাতার ফুটবল ক্লাবে আদতে কসমোপলিটন কালচার ৷ ভিন্ন প্রদেশ এবং দেশ থেকে আসা ফুটবলাররা যাতে এই শহরের ফুটবল সংষ্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, তারই ব্যবস্থা ৷ ফলে নববর্ষের সকালে ক্লাব মিলনক্ষেত্র ৷ একসঙ্গে পুজো দেওয়ার পর পাত পেড়ে খাওয়ার আনন্দই আলাদা ৷
কেন করা হয় বারপুজো ? বারপুজো ঘিরে সংস্কারই বা কীরকম ?
কালীঘাট থেকে পুরোহিত এসে রীতি মেনে করতেন বা করেন এই বারপুজো ৷ বারের চারপাশে থাকে কিছু অতন্দ্র প্রহরী ৷ যারা পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারটিকে পাহারা দেন ৷ পাছে কেউ বার ডিঙিয়ে না যায় ৷ আসলে বার ডিঙোলে নাকি ক্লাবের পক্ষে তা অমঙ্গল ৷ এমনটাই মানেন ক্লাব কর্তারা ৷ বার পোতার সময় অবস্থান যাতে বেকে না যায় সেই ব্যাপারেও সতর্কতা বজায় রাখা হয় ৷
আগে পুরো গ্যালারি ভরে যেত বারপুজো দেখতে ৷ আসলে বারপুজো নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে ৷ ক্লাবের কর্তারা মনে করেন বারপুজো করলে গোটা মরশুমটাই ভালো যায় ৷ আবার অনেকে বলেন বারপুজো করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হল, যাতে বিপক্ষের গোলের ক্ষেত্রে বার পোস্ট বাধা হয়ে দাঁড়ালেও ৷ নিজেদের দলের ক্ষেত্রে তা যেন কোনও সময়ই বাধা না হয় ৷ সত্তরের দশকে নাকি পুরোহিত অপহরণ হয়ে গিয়েছিলেন ৷ তারপর থেকেই পুরোহিত কে এবং কোথা থেকে আসছেন ? সেই ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় ৷
বারপুজোয় খাদ্য তালিকায় রকম ফের আছে ৷ মোহনবাগানে লুচি, ছোলার ডাল বা কাশ্মীরি আলুরদম কিংবা ছানার ডালনা থাকে ৷ সঙ্গে পান্তুয়া বা দরবেশ দেওয়া হয় ৷ ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরি হয় ৷ যার প্রস্তুতি শুরু হয় আগের দিন থেকে ৷ ইস্টবেঙ্গলের বারপুজোয় আসা সমর্থকদের রসগোল্লা খাওয়ানো হয় ৷ সঙ্গে ঠাণ্ডা শরবত দেওয়া হত ৷ গত দু’বছর ধরে পাত পেরে বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ৷ দুই প্রধান ছাড়াও ভবানীপুর, খিদিরপুর ইউনাইটেড স্পোর্টস ওয়াড়ি-সহ একাধিক ক্লাবে বারপুজো হয়ে থাকে ৷ আর সব ক্লাবেই বিষয়টি মিলন মেলা ৷