শিলিগুড়ি, 8 মার্চ : লড়াইটা একসময় শুরু হয়েছিল খেলোয়াড় হিসেবে ৷ সেই লড়াই চলছে এখনও ৷ তবে কোচ হিসেবে ৷ খেলোয়াড়ি জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন ৷ সেই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই দেশ তথা বাংলাকে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় উপহার দিতে এখনও অক্লান্ত শিলিগুড়ির ক্রীড়াগুরু ভারতী ঘোষ ৷ বাংলার টেবিল টেনিসের রানি হিসেবে পরিচিত ৷ বয়স আশির কোঠায় ৷
পরনে শাড়ি । ছোটখাটো শারীরিক গঠন । কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে খেলতে নামলে বড় বড় খেলোয়ারদের কেউ নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন তিনি । এই বয়সেও ফিটনেস চমকে দেবে । জীবনটাই খেলার প্রতি উৎসর্গ করেছেন শিলিগুড়ির ক্রীড়াগুরু এবং বঙ্গরত্ন ভারতী ঘোষ । টেবিল টেনিসের শহর নামে পরিচিত শিলিগুড়ি । গোটা দেশে এই শহর থেকেই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বহু খেলোয়াড়। আর প্যাডলার তৈরির কারিগর হলেন ভারতী ঘোষ । প্রশিক্ষকের ডিগ্রি না থাকলেও ভারতী ঘোষ শুধু উত্তরের নন, রাজ্যের অন্যতম সেরা টেবিল টেনিস কোচ তিনি । 80 বছর বয়সের ভারতী ঘোষ এখন সমাজের অনুপ্রেরণা ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে স্মৃতির পাতা হাতড়ে টেবিল টেনিসের গোড়ার দিকের কথা তুলে ধরেছেন ভারতী ঘোষ ৷ ভাইয়ের বন্ধুর সহযোগিতায় শিলিগুড়ির বিখ্যাত সেহগল ইনস্টিটিউটে ভরতি হন ৷ হাতেগোনা কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলা শুরু করেন ৷ কোনও কোচ ছাড়াই শুরু হয় প্রশিক্ষণ ৷ সিনিয়রদের খেলা দেখে শিখতে থাকেন ৷ এরপর মহাবীরস্থানের একটি কোচিং ক্যাম্পে ভরতি হন । খুব অল্প সময়ে খেলাটিকে আয়ত্ত করে ফেলেন ভারতী ঘোষ ।
আরও পড়ুন : ময়দানের সম্রাজ্ঞীরা
প্রশিক্ষণের ভাবনা শুরু তখন থেকেই ৷ তবে মাথায় ছিল ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের খেলা শেখানোর কথা । যেমন ভাবা তেমন কাজ । নিজেই শুরু করেন টেবিল টেনিসের প্রশিক্ষণ দেওয়া । শিলিগুড়ি তো বটেই দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে শিশুদের টেবিল টেনিসের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন । বেতন দিতে অসমর্থ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বিনামূল্যে কোচিং করাতে শুরু করেন ৷ প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়রাও তাঁর কাছে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ পেয়েছে ৷ এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন টানা 50টা বছর । নিজের খেলা এবং প্রশিক্ষণের মাঝে যাতে কোনওরকম বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য বিয়ে পর্যন্ত করেননি । 30 বছর বয়সে রেলে চাকরি পান । তবে সমানতালে চালিয়ে গিয়েছেন প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ ৷ অবসরের পর এখন পুরো সময়টাই ছোট ছোট শিশুদের প্রশিক্ষণের পিছনে ব্যয় করেন ৷
টেবিল টেনিসকে সঙ্গী করেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময় । দেশবন্ধু পাড়ায় একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন ৷ নিজেই রান্না করেন ৷ একা হাতে সব কাজ সামলে কোচিংয়ের জন্য সময়মতো পৌঁছে যান । এখনও সপ্তাহে সাতদিন দু'বেলা পালা করে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন তিনি। ভারতী ঘোষের হাতে তৈরি হয়েছে অন্তত তিন হাজার টেবিল টেনিস খেলোয়াড় । রাজ্য তো বটেই এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিনিধিত্ব করেছে অনেক ছাত্রছাত্রী । রাজ্য সরকারের তরফে 2019 সালে বঙ্গরত্ন এবং 2021 সালে ক্রীড়া দপ্তরের তরফে 'ক্রীড়া গুরু' সম্মানে ভূষিত করা হয় ।
আরও পড়ুন : হারিয়ে যাওয়া সেপাক টাকরোকে ফেরাতে বাংলায় পার্থই 'সারথি'
ভারতী ঘোষের বলছেন, "বঙ্গরত্ন এবং ক্রীড়া গুরু সম্মান পাওয়ায় আমি যে বড় কিছু হয়ে গিয়েছি তা নয় ৷ আমাকে আরও অনেক খেলোয়াড় তৈরি করতে হবে । আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি ৷ তাই থাকব ।" দুস্থ এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন প্রতি বিশেষ নজর রাখেন তিনি । শহরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিশিষ্ট বড় বড় টেবিল টেনিস কোচিং ক্যাম্প থাকলেও শহরের সিংহভাগ অভিভাবকদের ভরসার মানুষ হলেন ভারতী ঘোষ । এক অভিভাবিকা পিয়ালী বোস বলেন, "এই বয়সেও দিদি যেভাবে ছোট ছোট শিশুদের যত্ন করে খেলা শেখাচ্ছেন তাতে সত্যিই আমি অবাক । উনি আমাদের গর্ব ।"