হায়দরাবাদ, 11 জানুয়ারি: ক্রিকেট জেন্টলসম্যান গেম । গোদা বাংলায় ভদ্রলোকের খেলা । সবুজ গালিচায় নেমে বারবার এই প্রবাদের নয়া সংজ্ঞা দিয়েছেন ইন্দোরের এক যুবক, নাম রাহুল শরদ দ্রাবিড় । মৃদুভাষী, শান্তশিষ্ট জ্যামিই ছিলেন বোলারদের কাছে বিভীষিকা । আক্রমণাত্মক কিংবা মারকুটে নন, উইকেটের সামনে সদা শান্ত রাহুল ।
সাতের দশকে হেলমেট ছাড়া খেলতে হত ব্যাটারদের । সামলাতে হত বিধ্বংসী ক্যারিবিয়ান পেসারদের । সুনীল গাভাসকার বলেছিলেন, হাতে ব্যাট থাকলে বল গায়ে লাগার কোনও প্রশ্নই নেই । বর্ণাঢ্য কেরিয়ারে সে পণটাই করেছিলেন 'দ্য ওয়াল' । উইকেটের সামনে এমন বর্ম তুলে দাঁড়াতেন, জ্যামির নামই হয়ে গিয়েছিল 'দ্য ওয়াল' । শুধু ব্যাটারই নয়, স্লিপে দাঁড়ানো দ্রাবিড়কে সমীহ করতেন তাবড় তাবড় ব্যাটাররাও । অনিয়মিত উইকেটরক্ষক রাহুল আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে তালুবন্দি করেছেন 406 বার ।
2003 বিশ্বকাপে চূড়ান্ত টিমম্যান, ফাইনালে হারলেও বীরেন্দ্র সেহওয়াগের সঙ্গে বড় জুটি গড়েছিলেন দ্রাবিড় (57 বলে 47) । সচিন-সৌরভের ব্যর্থতার দিনে দলকে খানিক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চ পাণ্ডবের অন্যতম । 2007 বিশ্বকাপে শুধু ব্যাটার নয়, অধিনায়কের দায়িত্ব বর্তেছিল রাহুল দ্রাবিড়ের কাঁধে । যদিও জঘন্য পারফর্ম্যান্সে গ্রুপ পর্যায় থেকেই ছিটকে গিয়েছিল 'মেন ইন ব্লু', হারতে হয়েছিল বাংলাদেশের কাছেও ।
কোচ রাহুল:
খেলোয়াড় হিসেবে যতটা বন্দিত, দ্রোণাচার্যের ভূমিকায় ততটাই প্রশংসিত দেশের অন্যতম সফল ব্যাটার । এনসিএ প্রধান হিসেবে তৃণমূল স্তর থেকে খেলোয়াড় তুলে আনায় পারদর্শী দ্রাবিড়কে অনুর্ধ-19 দলের দায়িত্ব দিয়েছিল বিসিসিআই । তাঁর হাত ধরে তখন তৈরি হচ্ছেন শুভমন গিল, ঈশান পোড়েলের মতো ক্রিকেটাররা ৷ বিশ্বকাপ সফরে অজেয় থেকে ট্রফি হাতে তুলেছিল পৃথ্বী শয়ের দল ৷ বিশ্বকাপের স্কোরকার্ডে চোখ রাখলেই ছবিটা পরিষ্কার হবে । বিশাল বিশাল ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়েছিল অনুর্ধ্ব-19 দল । সেবার অস্ট্রেলিয়াকে 100 রানে, পাপুয়া নিউগিনিকে 10 উইকেটে, জিম্বাবোয়েকে 10 উইকেটে, বাংলাদেশকে 131 রানে হারায় ভারত ৷ সেমিফাইনালে তো পাকিস্তানকে দাঁড়াতেই দেননি গিলরা ৷ পাকিস্তানকে তাঁরা হারান 230 রানে ৷ আর তারপর ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া 8 উইকেটে ধরাশায়ী ।
তারপরেই বড়দের দলের হেডস্যরের দায়িত্ব পান রাহুল । কানের পাশে চুলে একটু পাক ধরেছে ৷ বয়সটা পৌঁছে গিয়েছে হাফ-সেঞ্চুরির কাছাকাছি ৷ এই রাহুল একদিন দলের জন্য হাতে তুলেছিলেন কিপিং গ্লাভস ৷ তেমনই এবার তুলে নেন হেডস্যরের দায়িত্ব ৷ প্রশাসকের চেয়ারে বসে সেদিন সেই কাজটা করেছিলেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় । ভারতীয় ক্রিকেটকে ফের সাফল্যের আলোয় নিয়ে আসতে কোচের চেয়ারে বসিয়ে ছিলেন দ্রাবিড়কে । টেস্ট ও ওডিআই, দুই ফর্ম্যাটেই দলকে এক নম্বর ব়্যাংকিংয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন । সদ্য বিশ্বকাপে দুরন্ত ফল করেছে 'মেন ইন ব্লু' । ফাইনালে অজিদের কাছে হারতে হলেও গোটা বিশ্বকাপে অপ্রতিরোধ্য ছিল ভারতীয় দল । তারপরেই দ্রাবিড়ের চুক্তি ফের বাড়িয়েছে বোর্ড ।
অচেনা দ্রাবিড়:
ক্রিকেটের সব ফর্ম্যাট থেকেই অবসর নিয়ে ফেলেছেন । শৈশবের ক্লাব বিইউসিসি (ব্যাঙ্গালোর ইউনাইটেড ক্রিকেট ক্লাব) কর্ণাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের টুর্নামেন্টে কার্যত ধুঁকছে । দ্রাবিড়ের কাছে অনুরোধ গেল, অবনমনের সীমায় থাকা দলের বিপদে পাশে দাঁড়াতে । স্টুয়ার্ট বিনির সঙ্গে জুটি বেঁধে সপ্তাহান্তে ক্লাবের হয়ে খেলেন দ্রাবিড় । অবসরের পর সাধারণত খেলোয়াড়রা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান । সেখানে সপ্তাহান্তে 30-40 কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে মাঠে যেতেন দ্রাবিড় । শুধু তাই নয়, দুরন্ত সেঞ্চুরিতে দলকে অবনমন থেকে বাঁচান ।
একনজরে দ্রাবিড়নামা:
- প্রথম ভারতীয় হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচটি ডবল সেঞ্চুরির মালিক । যার প্রত্যেকবার আগেরবারের স্কোরকে ছাপিয়ে গিয়েছেন 'দ্য ওয়াল' ।
- প্রথম ভারতীয় যিনি টানা চার টেস্ট ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন ।
- টেস্ট ইতিহাসে প্রথম অনিয়মিত উইকেটরক্ষক যিনি উইকেটের পিছনে 200টি ক্যাচ নিয়েছেন ।
- টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি তাঁর সময়ের প্রতিটি টেস্ট খেলা দেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছেন ।
- খেলোয়াড় হিসেবে 2003 বিশ্বকাপের ফাইনাল । অধিনায়ক হিসেবে 2007 বিশ্বকাপে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা রাহুল সফল কোচের ভূমিকাতেও ।
- হেডস্যর হিসেবে বিশ্বসেরা করেছেন অনুর্ধ-19 দলকে ।
- তাঁর কোচিংয়েই 2023 বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেছিল ভারতীয় দল ।
চিরকালই তিনি 'সেকেন্ড বয়' ৷ সচিন-সৌরভদের ঊজ্জ্বল আলোর পাশে নীরবে নিজের কাজ করে যাওয়া ক্লাসের 'গুড বয়' ৷ যদিও টেস্ট হোক বা ওয়ান ডে, তাঁকে দলের ক্রাইসিস ম্যানেজার হতে হয়েছে বারবার ৷ 2001 সালের ইডেন হোক বা 2003 সালের অ্যাডিলেড ৷ কোচের ভূমিকাতেও দক্ষ কম্পোজারের মতো দলকে বিনিসুতোয় নীরবে নিভৃতে বেঁধে রাখছেন ব্যান্ডমাস্টার রাহুল দ্রাবিড় । স্বভাবসিদ্ধ বিনম্র অঙ্গুলিহেলনে । ফলে খেলোয়াড় বা কোচ, দুই ভূমিকাতে বিশ্বকাপ অভিযানে তীরে এসে তরী ডুবলেও এখনও 'মিঃ ডিপেন্ডেবল' দ্রাবিড়ই ।
- " class="align-text-top noRightClick twitterSection" data="">
আরও পড়ুন: