ফলাফল যাই হোক না কেন, ব্রেক্সিট যে হচ্ছেই, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই নেই। ব্রেক্সিট-এর মুখ বরিস জনসন তাঁর বহুলচর্চিত স্লোগান ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’-এর উপর নির্ভর করে শুক্রবার এক অসামান্য জয় পেলেন। জুলাই মাসে থেরেসা মে-র বিদায়ের পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। আর তাঁর নেতৃত্বেই কনজা়রভেটিভরা ১৯৮৭ সালের মার্গারেট থ্যাচারের পর এত বড় জয় পেল। ২০১৬ সালে গণভোটে স্থির হওয়া ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তের পর গত তিন বছর ধরে অযথা বিলম্ব জনসনের জয়ের রাস্তাটা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছিল, যিনি আগামী জানুয়ারির মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও ১৪টি নতুন সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, ২০ হাজার নতুন পুলিশকর্মী, ৫০ হাজার নার্স, রুগ্ন NHS-এ আরও বিনিয়োগ প্রভৃতিও ছিল জনসনের লম্বা প্রতিশ্রুতির তালিকায়, তবে তাঁর জেতার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে ‘গেট ব্রিক্সিট ডান’ স্লোগানটাই। সাড়ে ছয়শো আসনের হাউসে কনজারভেটিভরা এখন ৭৮ আসনের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে।
ভোটে কনজারভেটিভের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির বিপুল পরাজয় হয়েছে। দলের মুখ জেরেমি করবিন সম্ভবত গত ৫০ বছরের মধ্যে লেবারদের সবচেয়ে অপ্রিয় নেতা। তিনি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বে আদর্শের ভিত্তিতে বিভাজন করে কঠিন বাম নীতির স্বাপেক্ষে সমর্থনের ভিত মজবুত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মুক্ত বাজার তত্ত্বের বিরোধিতা, বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি শিল্প ও পরিষেবার পুনর্জাতীয়করণের আশ্বাস, সুপ্ত ইহুদি ও মার্কিন বিদ্বেষ এবং রুশপন্থী বিদেশ নীতিতে বিশ্বাস করার মতো খুব সামান্য লোকই ছিলেন এই একবিংশ শতকে। এক কথায় বলতে গেলে, তিনি পড়েছিলেন সেই ঠান্ডা যুদ্ধের আমলে, যখন বাকি পৃথিবী অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ফলাফল, ভোটে লেবার পার্টির মাত্র ২০৩টি আসনে জয় এবং ৫৯টি আসন হারানো। ব্রেক্সিট নিয়ে করবিনের বিভ্রান্তিকর নীতির ফলে লেবারদের শক্ত ঘাঁটিতেও থাবা বসিয়েছে টরিয়েসরা।
নিজেকে নিরপেক্ষ হিসাবে প্রচার করে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে ব্রেক্সিট নিয়ে আরও একটি গণভোটের। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, ব্রেক্সিট আন্দোলনের একেবারে পুরোভাগে ছিলেন লেবার পার্টির তৃণমূলস্তরের সমর্থক ও কর্মীরা । ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার পর থেকে পূর্বতন সোভিয়েত দেশগুলি থেকে সস্তার শ্রমিকের আসার ফলে ব্রিটেনের কাজ করা পুরুষ শ্রেণি নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করে। কিন্তু এই বিষয়টিতে করবিন ও লেবার পার্টির অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। এই সব কারণেই যে সব আসনে গত ৫০ বছরে টরিয়েন্সরা জিততে পারেনি, সে সব আসনও জিতেছে তারা। অন্য দিকে, লন্ডনে বাকি শক্তিশালী আসনগুলিতে লেবার পার্টি কোণঠাসা ছিল তাঁদের পিছিয়ে পড়া শ্রমিক নীতির জন্য। ফলে জনসনের জয়ের রাস্তাটা আরও পরিষ্কার হয়। তবে এত কিছুর পরেও বিপুল হারের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে করবিন পদত্যাগ করেননি। উল্টে বলেছেন, দল এখন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়া শেষ হবে এক বছর পর। অন্যদিকে লিবারাল-ডেমোক্র্যাটদের নেতা জো সুইনসন, যিনি নিজের আসনেও জিততে পারেননি, নির্বাচনে দলের পরাজয়ের দায় নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইস্তফা দিয়েছেন। তবে, বাকি দেশের রায়ের একেবারে উল্টো রাস্তায় হেঁটে স্কটল্যান্ডে নিকোলা স্ট্রুজিয়নের নেতৃত্বে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ৪৮টি আসন পেয়েছে, যা গত বারের চেয়েও ১৩টি বেশি।
ভোটে বিপুল জয়ের পরেই স্কটল্যান্ড ব্রিটেনের সঙ্গে থাকবে না, স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, সে বিষয়ে দ্বিতীয় গণভোটের দাবি জোরালো হয়। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গলা ফাটিয়েছেন খোদ স্ট্রুজিয়ন। ২০১৬ সালে অবশ্য প্রথম বারের গণভোটে ব্রিটেনের সঙ্গে থাকার বিষয়ই সম্মত হয়েছিল স্কটল্যান্ড । কিন্তু আগামী জানুয়ারির মধ্যে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে সেটা তারা খুব একটা ভাল ভাবে নেবে না। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে বুঝতে পেরে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জনসন জোর দিচ্ছেন ‘ওয়ান ব্রিটেন’ স্লোগানে, বলছেন জাতীয় ঐক্যের কথা। তবে এ কথা মানতে কোনও অসুবিধা নেই যে, ৩১ জানুয়ারি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার পর ব্রিটেনের জন্য খুব কঠিন সফর অপেক্ষা করছে। এর পর ২৭ দেশের জোট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্রিটেনের জন্য সহজ বাণিজ্য চুক্তি করে কি না সেটাই এখন দেখার। তবে বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়িত হতে বহু বছরও লেগে যেতে পারে এবং তা জনসনের প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে স্থির না হতেও পারে। এর সঙ্গে রয়েছে তাঁকে ঘিরে বিশ্বাসহীনতার আবহ। কনজা়রভেটিভদের বিপুল জয়ের পরে পাউন্ড, স্টারলিংয়ের দামে উন্নতি হলেও ব্রিটেনের শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্রেক্সিট একটা বড় ভূমিকা নিতে চলেছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। ব্রিটেন নিজেও এখন একটি ক্রমহ্রাসমান শক্তি, যার অর্থনীতির উন্নতির জন্য শক্তশালী বাণিজ্য-সঙ্গীর প্রয়োজন। শেষ ত্রৈমাসিকে তাদের বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। তাঁর বেপরোয়া, হঠকারী চরিত্র দিয়ে কিন্তু জনসন আর ব্রিটেন শাসন করতে পারবেন না। এ বার তাঁর প্রয়োজন হবে কঠিন পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও বুদ্ধির। প্রয়োজন হবে দলকে একত্রিত রাখা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সহজ ও সুফল প্রদানকারী বাণিজ্য চুক্তি করা।