সীমান্ত রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে , নাগাল্যান্ডের রাজ্যপাল তাঁর নির্দিষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিওকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ।
রাজ্যপাল সিনিয়র সরকারি আধিকারিকদের নিয়োগ করার পূর্ণ ক্ষমতা চেয়েছেন । কারণ হিসাবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে ব্যাপক তোলাবাজি এবং ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতী’-দের অবৈধ কাজকর্মের জেরে নাগাল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে ।
এই চিঠির জেরে বিভিন্ন অংশ এবং রাজনৈতিক দলগুলির থেকে নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে । উত্তর-পূর্বের নাগা অধ্যুষিত এলাকার সবথেকে বড় জঙ্গিগোষ্ঠী , ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগালিম-এর আইজ্যাক মুইভা গোষ্ঠী (NSCN-IM) জবাবে বলেছে যে , তারা শুধু ‘বৈধ কর’ নেয় । অন্যান্য গোষ্ঠীর বক্তব্য, তারা শুধু ‘অনুদান’ নেয় ।
রাজ্যপাল তাঁর চিঠিতে লিখেছেন , 'হাফ ডজ়নের বেশি সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠী’ পার্বত্য রাজ্যে কর চাপাচ্ছে । 1975 সালের শিলং চুক্তির বিরোধিতা করে 1980 সালে যে অবিভক্ত NSCN তৈরি হয়েছিল , এই গোষ্ঠীগুলির বেশিরভাগ তার অংশ ।
বাস্তবে , বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে নাগাল্যান্ড এবং মায়ানমারের নাগা অঞ্চলে সমান্তরাল সরকার চালিয়ে আসছে । বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে প্রায় রসিদ দিয়ে কর নেওয়া হয় , যা গোষ্ঠীর সদস্য বা মধ্যস্থকারীরা সংগ্রহ করে ।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল আর এন রবিকে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে হল কেন ?
কোভিড-১৯-এর প্রভাব?
নাগাল্যান্ডের অনেক বাসিন্দাই মনে করছেন যে সড়কপথে তাঁদের জিনিসপত্র নিয়ে আসা ট্রাকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির ‘কর’ চাপানো গত তিন মাসে বেড়ে গিয়েছে । এই ধরনের কাজে জড়িত সন্দেহে কিছু লোককে গত কয়েক সপ্তাহে আটক করেছে পুলিশ ।
গত বছর যখন সবাই মনে করছিলেন যে সরকার শীঘ্রই চুক্তি সই করতে পারে , তখন আরও নিয়োগের প্রেক্ষিতে এইসব সংগঠনগুলির খরচ বেড়ে যায় । আশা করা হয়েছিল যে সংগঠনের সদস্যরা পুলিশের নতুন ব্যাটেলিয়ন এবং সেনার নাগা রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে ।
সংগঠনগুলি তাদের প্রভাব বাড়াতে চায় , যাতে তারা সরকারের কাছ থেকে সমস্তরকম সুবিধা পেতে পারে । যখনই সরকারের সঙ্গে কোনও চুক্তি হয় , তখনই এই অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলির মধ্যে এই ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে । 1992 সালে আসাম সরকার ভুয়ো তালিকা তৈরি করেছিল , যেখানে আত্মসমর্পণকারী আলফা সদস্য এবং বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয় , এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
গত বছর 25 নভেম্বর , সংবাদমাধ্যমে জানানো হয় যে , অসম রাইফেলস এবং সেনাবাহিনীর যৌথ স্কোয়াড , নাগাল্যান্ডের মন জেলায় NSCN(IM)-এর একটি গোপন নিয়োগের প্রচেষ্টা বানচাল করে দিয়েছে । তবে এটা ছিল এই ধরনের ঘটনাগুলির মধ্যে মাত্র একটা , যা অন্য গোষ্ঠীগুলি পরিকল্পনা করেছিল এবং যা আর গোপন নেই ।
দ্বিতীয়ত , এইসব গোষ্ঠীর আয়ের একটা বড় অংশ আসে বাণিজ্যিক সংস্থা এবং ডিমাপুরের কমার্শিয়াল হাবের দোকানগুলি থেকে । শহরের হংকং মার্কেট , যেখানে বেশিরভাগ চোরাপথে আসা চিনা জিনিস বিক্রি হয় , তা মার্চ থেকেই বন্ধ । পুরো দেশের মতো , COVID -19 রাজ্যজুড়ে ব্যবসার উপর প্রভাব ফেলেছে , যার ফলে গোষ্ঠীগুলি কম টাকা তুলতে পারছে ।
তাই তাদের কাছে একমাত্র রাস্তা হচ্ছে প্রতিদিন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে মণিপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া শয়ে শয়ে ট্রাকগুলি । আশ্চর্যের কিছু নেই যে , নাগাল্যান্ডে গত চার মাসে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে ।
সুরাহার উপায় কী?
নাগাল্যান্ডে দশকের পর দশক ধরে চলা সংঘাতের সামরিক সমাধান হতে পারে না । BJP নেতৃত্বকে বুঝতে হবে যে , জম্মু-কাশ্মীরে যে কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে , তাতে উত্তর-পূর্বে কাজ নাও হতে পারে ।
নাগাল্যান্ডে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় 1997 সালে যখন NSCN(IM) সরকারের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর এগিয়ে আসে এবং কয়েক বছর পর NSCN(Khaplang)-এর সঙ্গেও একইধরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । পরে অন্যান্য গোষ্ঠীও শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় এটা নিশ্চিত করতে , যাতে একটা চুক্তির মাধ্যমে অশান্ত রাজ্যে সংঘাত আর না বাড়ে , যেমনটা হয়েছিল শিলং চুক্তির সময় ।
একমাত্র পতাকা ও সংবিধান ছাড়া , বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি (যাদের নাগা ন্যাশনাল পলিটিক্যাল গ্রুপও বলা হয়) এবং সরকারের মধ্যে সমস্ত বিষয়ের মীমাংসা হয়েছে । NSCN(IM) -এর নেতৃত্বে তাদের কয়েকটি গোষ্ঠী এখনও এই দাবিগুলিতে অনড় , যা সরকার মানতে রাজি নয় ।
নাগাল্যান্ডের বহু বর্ষীয়ান নাগরিক এবং নাগরিক সমাজ গোষ্ঠী জঙ্গি সংগঠনগুলির কাজের বিরোধী , কিন্তু তাদের তোলা ইশুগুলিতে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে ।
নাগা মাদার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা রোজ়মেরি জুভিচু বলেন , এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে যদি রফাসূত্র অধরা থাকে । তিনি বলেন , “ দীর্ঘ শান্তি আনতে এবং নাগা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে গুরুত্ব দিতেই হবে ।”
নাগাল্যান্ড এবং অন্যান্য রাজ্যে শান্তি প্রক্রিয়াকে একটা যুক্তিপূর্ণ সমাধানে পদক্ষেপ আনা উচিত । যেখানে কেন্দ্রের এই অঞ্চলের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা রয়েছে , যার মধ্যে রয়েছে অ্যাক্ট ইস্ট নীতিও । নাগাল্যান্ডের গুরুত্ব রয়েছে , যেহেতু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলির পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে , মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ একমাত্র সম্ভব মণিপুরের মধ্যে দিয়ে , মিজ়োরাম নয় ।
( প্রতিবেদনটি লিখেছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক রাজীব ভট্টাচার্য )