ETV Bharat / international

অদৃষ্টপূর্ব মেরুকরণ ঘটেছে অ্যামেরিকায় : ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত

author img

By

Published : Nov 3, 2020, 5:07 PM IST

Updated : Nov 4, 2020, 7:11 AM IST

অ্যামেরিকার বড় শহরগুলির বড় বড় বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলি এখন সে দেশের । মতে , বর্ষীয়ান সাংবাদিক স্মিতা শর্মা-র সঙ্গে একটি এক্সক্লসিভ সাক্ষাৎকারে অ্যামেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্কর জানান , প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে প্রবল হিংসার আশঙ্কা করা হচ্ছে , সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রে এই অভূতপূর্ব অবস্থার জন্য দায়ি রাষ্ট্র ।

America election
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্কর

অ্যামেরিকার বড় শহরগুলির বড় বড় বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলি এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রবল হিংসার আশঙ্কা করছে । এই ধরনের ভয় বা আশঙ্কার ঘটনা অভূতপূর্ব । অ্যামেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্করের মতে , বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রে এই অভূতপূর্ব অবস্থার জন্য দায়ি রাষ্ট্র । সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে দলীয় সমর্থকদের বলেছেন যে, তিনি যদি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় না আসতে পারেন, তা হলে এই নির্বাচনের ফল না মানতে । মীরা জানালেন , এটা একেবারেই অভূতপূর্ব একটা ঘটনা । সিনিয়র জার্নালিস্ট স্মিতা শর্মার সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শঙ্কর আরও বলেছেন যে , অ্যামেরিকার সমাজে এই রকম মেরুকরণ এর আগে কখনও হয়নি । সে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, যাঁরা এত দিন বিদেশনীতি এবং অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে জাতীয় সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরাই এখন চরম ডানপন্থী বা চরম বামপন্থী অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছেন । এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বিডেনের বিভিন্ন মতাদর্শগত পার্থক্য, কেন বহু দলীয় রাজনীতি অ্যামেরিকায় জনপ্রিয় নয় , প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভবিষ্যত বাণী , বিভিন্ন প্রদেশগুলির অবস্থান পরিবর্তন এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত । এখানে রইল তার সারাংশ ।

প্রশ্ন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন খুব বড় ধরনের হিংসা ও হানাহানির আশঙ্কা সম্বন্ধে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

উত্তর : এটা যে অভূতপূর্ব, সে বিষয়ে কোনও রকম সন্দেহই নেই । অ্যামেরিকার মতো শক্তিশালী এবং স্বনামধন্য একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের অবস্থার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি এত দিন । কিন্তু এর অনেকটাই সে দেশের অদৃষ্টপূর্ব প্রেসিডেন্ট শাসনের ফলাফল । সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাধিক অদ্ভুত মন্তব্য যখন তিনি বলেন যে তিনি নির্বাচনের ফলাফল মানবেন না বা ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি করতে পারে বা ব্যালট মেল করে দেওয়া থেকে ভয়ঙ্কর কারচুপি হয় ইত্যাদি । অর্থাৎ, নির্বাচনের আগেই ভোটের ময়দানে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়া এক রাজনৈতিক নেতা সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভিত্তি এবং তার সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন । অতএব যা হওয়ার তাই হয়েছে, তাঁর সমর্থকরাও তাঁর মতো বিপ্রতীপ আচরণ করছেন । ডানপন্থী উগ্রপন্থীরা বন্দুক পরিস্কার করা শুরু করেছে । তাঁদের এই উদ্দীপনা , ‘প্রেরণা’, যে একেবারে আকাশ থেকে আচমকা নেমে এসেছে এমনটা একেবারেই নয় । এদের এই ধরনের আচরণের কারণ হল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী এই বিষয়টিকে তাঁর নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজির অংশ করে ফেলেছেন ।

অদৃষ্টপূর্ব মেরুকরণ ঘটেছে অ্যামেরিকায় : ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত

প্রশ্ন: অ্যামেরিকার নির্বাচনে এর আগেও বহু কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে । আপনার কি মনে হয় যে 2020 সালের নির্বাচন অ্যামেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে দেবে?

উত্তর:এ বারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী কৌশল এবং ‌দৃষ্টিভঙ্গী একেবারে আলাদা । আর্থিক নীতি হোক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত কোনও বিষয় হোক বা আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় হোক বা শক্তি সংক্রান্ত কোনও নীতি হোক বা বিদেশ নীতি, সব ক্ষেত্রেই এ বারের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন । দুই জনই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন অ্যামেরিকার সাধারণ মানুষকে এই কথা বোঝাতে যে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাঁদের ব্যাখ্যাই সঠিক । তাঁর দেখানো পথই সেরা পথ । এর থেকে আরও একটা বিষয় বোঝা যায় যে , শেষ কয়েক বছরে অ্যামেরিকায় ঠিক কতটা মেরুকরণ হয়েছে । অতীতে বহুবার দেখা গিয়েছে যে, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা অংশ সব সময়ই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন এবং যে কোনও বড় বিষয়, তা সে বিদেশনীতি সংক্রান্ত কিছু হোক বা অর্থনীতি সংক্রান্ত, সাধারণ ভাবে একটা সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন । এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কিন্তু সেই ধরনের কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । সে দেশে এখন রয়েছে এমন দুই দল যাদের চলার পথ একেবারে দুই বিপরীত দিকে । একদিকে রয়েছে রিপাবলিকান পার্টি, যারা আপাতত টি পার্টি আন্দোলনের কব্জায় । এই টি পার্টি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে এক দল ডানপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি । অপর দিকে রয়েছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি যাদের বামপন্থী একটা অংশ রয়েছে । এই অংশের নেতারা মারাত্মক জেদি এবং নিজেদের মতকেই প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী । কংগ্রেস এবং হাউজ় অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাটদের বহু তরুণ নেতা এসেছেন এই অংশ থেকে । তাই দুই পক্ষই যেন একে অপরের ঠিক বিপরীত দিকে চলেছে ।

ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বিডেন একজন মধ্যপন্থী নেতা । এখনও পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাস্ত করতে ডেমোক্র্যটিক পার্টি এক জোট রয়েছে । এমনকী , বার্নি স্যান্ডার্সের মতো দলের বামপন্থীরা বিডেনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পদকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন । কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর পর যদি দেখা যায় জো বিডেন জিতে গিয়েছেন , তাহ‌লে তিনি নিজের দলের বামপন্থী অংশ এবং রিপাব‌লিকান দলের যে অংশটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরব, তাদের সবাইকে চলতে যথেষ্ট বেগ পাবেন । চিরাচরিত রিপাবলিকানরা, অর্থাৎ যাঁরা রোনাল্ড রেগন বা জর্জ বুশ সিনিয়র বা জর্জ বুশ জুনিয়রের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন বা দেখেছেন, তাঁরা খোলাখুলি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন । এটাকে তারা আব্রাহাম লিঙ্কনের নামে রাখা লিঙ্কন প্রজেক্ট হিসাবে নাম দিয়েছে । শুধু সমালোচনা করাই নয় , তাঁরা একেবারে প্রচার শুরু করেছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে সরাসরি ভোটারদের অনুরোধ করছেন ট্রাম্পকে ভোট না দিয়ে জো বিডেনকে ভোট দেওয়ার জন্য । ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজের সংসদীয় কেন্দ্র একেবারে প্রথম থেকেই তাঁর কট্টর সমর্থক । তাই তাঁর খুব খারাপ সময়ও তাঁর অ্যাপ্রুভাল রেটিং অর্থাৎ তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্রায় 42 শতাংশ মানুষ । তাঁর অ্যাপ্রুভাল রেটিং বেশিরভাগ সময়ই একই রকম থেকেছে । তিনি নির্বাচনী কৌশল হিসাবে আইনকানুনের সমস্যা, বর্ণ বৈষম্যের ফলে হওয়া বড় সমস্যার মতো বিষয়গুলি সামনে এনে তাঁর থেকে মুখে ফেরানো শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের কাছে টানতে চাইছেন । আফ্রিকান এবং ল্যাটিনো ভোটারদের কাছে টানতে তিনি বলছেন, তাঁর আমলে কোরোনা পূর্ববর্তী সময়ে তাঁদের বেকারত্ব সম্ভবত সবচেয়ে নীচের দিকে ছিল ।

প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেন সে ভাবে উঠে আসেনি?

উত্তর : আমার কিন্তু মনে হয় দুই দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা সামলাতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে অবশ্য তাদের সামনে নির্দল প্রার্থীরা রয়েছেন। আল গোরের সময় এই বিষয়টা দেখা গিয়েছে। এমনকি গত বারেও হিলারি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে গ্রিনদের সমর্থনে এক জন নির্দল প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে আমেরিকার মূল স্রোতের রাজনীতি এই দুই দলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাকি দলগুলি তেমন‌ কিছু করতে পারেনি। দুই দলেরই মতাদর্শ আলাদা। তাই তাদের নেতা বা কর্মীদের চিন্তা ভাবনাও ভিন্ন। টি পার্টিও আলাদা নয়। তারা রিপাবলিকান পার্টির অংশ। ঠিক যেমন ডেমোক্র্যাট পার্টির মধ্যে প্রগ্রেসিভরা আলাদা নয়। বামপন্থী প্রগ্রেসিভরাও তাদের অংশ।

প্রশ্ন:অ্যামেরিকান পোলস্টার এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা কীভাবে টানা দ্বিতীয় নির্বাচনের জন্য ভুল করে যাচ্ছেন যেখানে জাতীয় সমীক্ষাগুলি জো বিডেনকে গুরুত্ব দিয়েছিল?

উত্তর: জাতীয় স্তরের বেশিরভাগ সমীক্ষাই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে জো বিডেনকে খানিকটা এগিয়ে রাখছে । গত কয়েক সপ্তাহ বা শেষ 15 দিনের নির্বাচনী সমীক্ষাগুলোর গড় যদি আমরা ভাল করে লক্ষ্য করি, তা হলে দেখতে পাব যে জাতীয় স্তরে জো বিডেনকে তারা 7.8 থেকে 10 শতাংশ পর্যন্ত লিড দিয়ে রেখেছে । কিন্তু বিষয়টা হল, কে অ্যামেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, তা এই ভোট শতাংশের উপর নির্ভর করে না । তা নির্ভর করে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের উপর যেগুলি হল প্রাদেশিক নির্বাচন । গত বারের নির্বাচনে ঠিক এই কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় 30 লাখ পপুলার ভোট বেশি পেয়েও হারতে হয়েছিল হিলারি ক্লিন্টনকে । হিলারি গতবার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ইলেক্টোরাল ভোট কম পেয়েছিলেন । তিনি সে বার পেনসিভেনিয়া, মিশিগান, উইসকনসিনের মতো সুইং প্রদেশগুলি হেরে গিয়েছিলেন যেগুলি চিরাচরিত ভাবে এবং নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা হত ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি হিসাবে । এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ চাকরিজীবীদের ভোট নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ এর মতো স্লোগান দিয়ে বা অ্যামেরিকা চাকরি ফেরত এনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে । অ্যামেরিকায় এমন একটি প্রদেশ রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে বিশ্বায়নের ফলে তারা পিছিয়ে পড়েছে এবং এর ফলে তাদের কোনও লাভ হয়নি । তারা বিশ্বাস করে বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদন সংক্রান্ত বহু কাজ চলে গিয়েছে চিনে এবং তথ্য প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার নির্ভর বহু কাজ চলে গিয়েছে ভারতে। তারা বিশ্বাস করে যে এর ফলে আম আমেরিকান চাকরিজীবীর বেতন সে ভাবে বাড়ছে না । বরং বেতন কমানোর কথা বলা হচ্ছে। জোর করলে তাদের বলা হচ্ছে যে, এ দেশে উৎপাদনে প্রচুর খরচ হচ্ছে এবং সংস্থা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে , এই কাজ বিদেশ থেকে কম খরচে করিয়ে নেবে । অ্যামেরিকার একটা গোটা প্রদেশ বিশ্বাস করে যে, বিশ্বায়নের ফলে সে দেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। আর তাই তারা নিজেদের মত পালটে ফেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে । তবে এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে জো বিডেন সামান্য হলেও এগিয়ে রয়েছেন একাট জায়গায় । আর তা হল, জো বিডেন নিজে এই চাকরিজীবী অ্যামেরিকানদের প্রতিনিধি । আর তাই এই মুহূর্তে সব সমীক্ষাই বলছে যে, জো বিডেন খুব ভালোভাবে মিশিগান, উইসকনসিনের মতো প্রদেশে এগিয়ে রয়েছেন । পেনসিলভেনিয়ার ক্ষেত্রে এই লিড কমে হয়েছে 5.5 শতাংশে । আবার ফ্লোরিডা বা জর্জিয়ার কথা যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে সব জায়গায় বিডেনের লিড কমে হয়েছে 2 শতাংশ । তাই বোঝাই যাচ্ছে লড়াইটা কতটা কাঁটায় কাঁটায় । আর এই সব প্রদেশের দিকেই কড়া নজর দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ।

অ্যামেরিকার বড় শহরগুলির বড় বড় বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলি এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রবল হিংসার আশঙ্কা করছে । এই ধরনের ভয় বা আশঙ্কার ঘটনা অভূতপূর্ব । অ্যামেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মীরা শঙ্করের মতে , বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রে এই অভূতপূর্ব অবস্থার জন্য দায়ি রাষ্ট্র । সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে দলীয় সমর্থকদের বলেছেন যে, তিনি যদি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় না আসতে পারেন, তা হলে এই নির্বাচনের ফল না মানতে । মীরা জানালেন , এটা একেবারেই অভূতপূর্ব একটা ঘটনা । সিনিয়র জার্নালিস্ট স্মিতা শর্মার সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শঙ্কর আরও বলেছেন যে , অ্যামেরিকার সমাজে এই রকম মেরুকরণ এর আগে কখনও হয়নি । সে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, যাঁরা এত দিন বিদেশনীতি এবং অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে জাতীয় সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরাই এখন চরম ডানপন্থী বা চরম বামপন্থী অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছেন । এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বিডেনের বিভিন্ন মতাদর্শগত পার্থক্য, কেন বহু দলীয় রাজনীতি অ্যামেরিকায় জনপ্রিয় নয় , প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভবিষ্যত বাণী , বিভিন্ন প্রদেশগুলির অবস্থান পরিবর্তন এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত । এখানে রইল তার সারাংশ ।

প্রশ্ন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন খুব বড় ধরনের হিংসা ও হানাহানির আশঙ্কা সম্বন্ধে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

উত্তর : এটা যে অভূতপূর্ব, সে বিষয়ে কোনও রকম সন্দেহই নেই । অ্যামেরিকার মতো শক্তিশালী এবং স্বনামধন্য একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের অবস্থার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি এত দিন । কিন্তু এর অনেকটাই সে দেশের অদৃষ্টপূর্ব প্রেসিডেন্ট শাসনের ফলাফল । সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাধিক অদ্ভুত মন্তব্য যখন তিনি বলেন যে তিনি নির্বাচনের ফলাফল মানবেন না বা ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি করতে পারে বা ব্যালট মেল করে দেওয়া থেকে ভয়ঙ্কর কারচুপি হয় ইত্যাদি । অর্থাৎ, নির্বাচনের আগেই ভোটের ময়দানে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়া এক রাজনৈতিক নেতা সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভিত্তি এবং তার সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন । অতএব যা হওয়ার তাই হয়েছে, তাঁর সমর্থকরাও তাঁর মতো বিপ্রতীপ আচরণ করছেন । ডানপন্থী উগ্রপন্থীরা বন্দুক পরিস্কার করা শুরু করেছে । তাঁদের এই উদ্দীপনা , ‘প্রেরণা’, যে একেবারে আকাশ থেকে আচমকা নেমে এসেছে এমনটা একেবারেই নয় । এদের এই ধরনের আচরণের কারণ হল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী এই বিষয়টিকে তাঁর নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজির অংশ করে ফেলেছেন ।

অদৃষ্টপূর্ব মেরুকরণ ঘটেছে অ্যামেরিকায় : ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত

প্রশ্ন: অ্যামেরিকার নির্বাচনে এর আগেও বহু কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে । আপনার কি মনে হয় যে 2020 সালের নির্বাচন অ্যামেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে দেবে?

উত্তর:এ বারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী কৌশল এবং ‌দৃষ্টিভঙ্গী একেবারে আলাদা । আর্থিক নীতি হোক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত কোনও বিষয় হোক বা আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় হোক বা শক্তি সংক্রান্ত কোনও নীতি হোক বা বিদেশ নীতি, সব ক্ষেত্রেই এ বারের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন । দুই জনই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন অ্যামেরিকার সাধারণ মানুষকে এই কথা বোঝাতে যে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাঁদের ব্যাখ্যাই সঠিক । তাঁর দেখানো পথই সেরা পথ । এর থেকে আরও একটা বিষয় বোঝা যায় যে , শেষ কয়েক বছরে অ্যামেরিকায় ঠিক কতটা মেরুকরণ হয়েছে । অতীতে বহুবার দেখা গিয়েছে যে, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা অংশ সব সময়ই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন এবং যে কোনও বড় বিষয়, তা সে বিদেশনীতি সংক্রান্ত কিছু হোক বা অর্থনীতি সংক্রান্ত, সাধারণ ভাবে একটা সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন । এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কিন্তু সেই ধরনের কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । সে দেশে এখন রয়েছে এমন দুই দল যাদের চলার পথ একেবারে দুই বিপরীত দিকে । একদিকে রয়েছে রিপাবলিকান পার্টি, যারা আপাতত টি পার্টি আন্দোলনের কব্জায় । এই টি পার্টি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে এক দল ডানপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি । অপর দিকে রয়েছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি যাদের বামপন্থী একটা অংশ রয়েছে । এই অংশের নেতারা মারাত্মক জেদি এবং নিজেদের মতকেই প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী । কংগ্রেস এবং হাউজ় অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাটদের বহু তরুণ নেতা এসেছেন এই অংশ থেকে । তাই দুই পক্ষই যেন একে অপরের ঠিক বিপরীত দিকে চলেছে ।

ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বিডেন একজন মধ্যপন্থী নেতা । এখনও পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাস্ত করতে ডেমোক্র্যটিক পার্টি এক জোট রয়েছে । এমনকী , বার্নি স্যান্ডার্সের মতো দলের বামপন্থীরা বিডেনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পদকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন । কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর পর যদি দেখা যায় জো বিডেন জিতে গিয়েছেন , তাহ‌লে তিনি নিজের দলের বামপন্থী অংশ এবং রিপাব‌লিকান দলের যে অংশটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরব, তাদের সবাইকে চলতে যথেষ্ট বেগ পাবেন । চিরাচরিত রিপাবলিকানরা, অর্থাৎ যাঁরা রোনাল্ড রেগন বা জর্জ বুশ সিনিয়র বা জর্জ বুশ জুনিয়রের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন বা দেখেছেন, তাঁরা খোলাখুলি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করছেন । এটাকে তারা আব্রাহাম লিঙ্কনের নামে রাখা লিঙ্কন প্রজেক্ট হিসাবে নাম দিয়েছে । শুধু সমালোচনা করাই নয় , তাঁরা একেবারে প্রচার শুরু করেছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে সরাসরি ভোটারদের অনুরোধ করছেন ট্রাম্পকে ভোট না দিয়ে জো বিডেনকে ভোট দেওয়ার জন্য । ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজের সংসদীয় কেন্দ্র একেবারে প্রথম থেকেই তাঁর কট্টর সমর্থক । তাই তাঁর খুব খারাপ সময়ও তাঁর অ্যাপ্রুভাল রেটিং অর্থাৎ তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্রায় 42 শতাংশ মানুষ । তাঁর অ্যাপ্রুভাল রেটিং বেশিরভাগ সময়ই একই রকম থেকেছে । তিনি নির্বাচনী কৌশল হিসাবে আইনকানুনের সমস্যা, বর্ণ বৈষম্যের ফলে হওয়া বড় সমস্যার মতো বিষয়গুলি সামনে এনে তাঁর থেকে মুখে ফেরানো শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের কাছে টানতে চাইছেন । আফ্রিকান এবং ল্যাটিনো ভোটারদের কাছে টানতে তিনি বলছেন, তাঁর আমলে কোরোনা পূর্ববর্তী সময়ে তাঁদের বেকারত্ব সম্ভবত সবচেয়ে নীচের দিকে ছিল ।

প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেন সে ভাবে উঠে আসেনি?

উত্তর : আমার কিন্তু মনে হয় দুই দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা সামলাতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে অবশ্য তাদের সামনে নির্দল প্রার্থীরা রয়েছেন। আল গোরের সময় এই বিষয়টা দেখা গিয়েছে। এমনকি গত বারেও হিলারি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে গ্রিনদের সমর্থনে এক জন নির্দল প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে আমেরিকার মূল স্রোতের রাজনীতি এই দুই দলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাকি দলগুলি তেমন‌ কিছু করতে পারেনি। দুই দলেরই মতাদর্শ আলাদা। তাই তাদের নেতা বা কর্মীদের চিন্তা ভাবনাও ভিন্ন। টি পার্টিও আলাদা নয়। তারা রিপাবলিকান পার্টির অংশ। ঠিক যেমন ডেমোক্র্যাট পার্টির মধ্যে প্রগ্রেসিভরা আলাদা নয়। বামপন্থী প্রগ্রেসিভরাও তাদের অংশ।

প্রশ্ন:অ্যামেরিকান পোলস্টার এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা কীভাবে টানা দ্বিতীয় নির্বাচনের জন্য ভুল করে যাচ্ছেন যেখানে জাতীয় সমীক্ষাগুলি জো বিডেনকে গুরুত্ব দিয়েছিল?

উত্তর: জাতীয় স্তরের বেশিরভাগ সমীক্ষাই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে জো বিডেনকে খানিকটা এগিয়ে রাখছে । গত কয়েক সপ্তাহ বা শেষ 15 দিনের নির্বাচনী সমীক্ষাগুলোর গড় যদি আমরা ভাল করে লক্ষ্য করি, তা হলে দেখতে পাব যে জাতীয় স্তরে জো বিডেনকে তারা 7.8 থেকে 10 শতাংশ পর্যন্ত লিড দিয়ে রেখেছে । কিন্তু বিষয়টা হল, কে অ্যামেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, তা এই ভোট শতাংশের উপর নির্ভর করে না । তা নির্ভর করে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের উপর যেগুলি হল প্রাদেশিক নির্বাচন । গত বারের নির্বাচনে ঠিক এই কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় 30 লাখ পপুলার ভোট বেশি পেয়েও হারতে হয়েছিল হিলারি ক্লিন্টনকে । হিলারি গতবার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ইলেক্টোরাল ভোট কম পেয়েছিলেন । তিনি সে বার পেনসিভেনিয়া, মিশিগান, উইসকনসিনের মতো সুইং প্রদেশগুলি হেরে গিয়েছিলেন যেগুলি চিরাচরিত ভাবে এবং নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা হত ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি হিসাবে । এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ চাকরিজীবীদের ভোট নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ এর মতো স্লোগান দিয়ে বা অ্যামেরিকা চাকরি ফেরত এনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে । অ্যামেরিকায় এমন একটি প্রদেশ রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে বিশ্বায়নের ফলে তারা পিছিয়ে পড়েছে এবং এর ফলে তাদের কোনও লাভ হয়নি । তারা বিশ্বাস করে বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদন সংক্রান্ত বহু কাজ চলে গিয়েছে চিনে এবং তথ্য প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার নির্ভর বহু কাজ চলে গিয়েছে ভারতে। তারা বিশ্বাস করে যে এর ফলে আম আমেরিকান চাকরিজীবীর বেতন সে ভাবে বাড়ছে না । বরং বেতন কমানোর কথা বলা হচ্ছে। জোর করলে তাদের বলা হচ্ছে যে, এ দেশে উৎপাদনে প্রচুর খরচ হচ্ছে এবং সংস্থা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে , এই কাজ বিদেশ থেকে কম খরচে করিয়ে নেবে । অ্যামেরিকার একটা গোটা প্রদেশ বিশ্বাস করে যে, বিশ্বায়নের ফলে সে দেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। আর তাই তারা নিজেদের মত পালটে ফেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে । তবে এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে জো বিডেন সামান্য হলেও এগিয়ে রয়েছেন একাট জায়গায় । আর তা হল, জো বিডেন নিজে এই চাকরিজীবী অ্যামেরিকানদের প্রতিনিধি । আর তাই এই মুহূর্তে সব সমীক্ষাই বলছে যে, জো বিডেন খুব ভালোভাবে মিশিগান, উইসকনসিনের মতো প্রদেশে এগিয়ে রয়েছেন । পেনসিলভেনিয়ার ক্ষেত্রে এই লিড কমে হয়েছে 5.5 শতাংশে । আবার ফ্লোরিডা বা জর্জিয়ার কথা যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে সব জায়গায় বিডেনের লিড কমে হয়েছে 2 শতাংশ । তাই বোঝাই যাচ্ছে লড়াইটা কতটা কাঁটায় কাঁটায় । আর এই সব প্রদেশের দিকেই কড়া নজর দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ।

Last Updated : Nov 4, 2020, 7:11 AM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.