কলকাতা, 20 মে: আজকাল একটা স্লোগান প্রায়ই শোনা যায় "বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান ।" আমজনতা তো বটেই শিল্পীর কাছে শিল্পীমহলও জানায় এমন আর্জি । কদিন আগে চিত্রটা ছিল একটু অন্যরকম । শাসক দলের সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেক শিল্পীরই কাজ ছিল না হাতে । এই নিয়ে প্রতিবাদ, লেখালিখি কম হয়নি । বলাবাহুল্য, একটু খেয়াল করলেই দেখা যেত তখন বাংলা ছবি বাঁচানোর থেকেও বেশি দলীয় সমর্থকদের দিয়েই কাজ চালানোর একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল । তা সে মধ্যমেধার হোক বা উচ্চ কিংবা নিম্ন । তবে খুশির কথা হল, এখন চিত্রটা অনেকটাই আলাদা । কাজ পাচ্ছেন অনেকেই । এই প্রসঙ্গে অভিনেতা জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "বিরোধী দলের হওয়ার কারণে অনেকের কাজ পেতে অসুবিধা হলেও আমার হয়নি ।"
তবে যোগ্য এবং একসময় দাপিয়ে কাজ করা অভিনেতার মধ্যেও কারও কারও কাছে নেই কাজ । বলতে দ্বিধা নেই, সেই তালিকায় নাম রয়েছে অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্যর (Rupa Bhattacharya news)। একের পর এক জনপ্রিয় ধারাবাহিকে নানা চরিত্রে বাজিমাত করেছেন তিনি । সম্প্রতি 'এসওএস কলকাতা'র মতো হেভিওয়েট ছবিতেও অভিনয় করেছেন পুলিশ অফিসারের চরিত্রে । শাড়ি পরে ফাইট সিন করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে । এ হেন রূপা এই মুহূর্তে 'সাথী' ধারাবাহিকে রয়েছেন কেবল গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সে । কেন এই না থাকা ? তা কি বিরোধী পক্ষের সমর্থক হওয়ার কারণে ? তিনি খোলা মনে, রাখঢাক না রেখে জানান অনেক কথা । তিনি বলেন, "সবার আগে বলি, আমি এখন সক্রিয় ভাবে কোনও দলে নেই । এসেওছিলাম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে । এরপর দলের বেশ কিছু ত্রুটির সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি । তাই সরে এসেছি । তা বলে এই নয় যে আমি দলবদল করেছি । আমি একজন শিল্পী । তারও আগে একজন সাধারণ মানুষ । স্বরূপ বিশ্বাস ইন্ডাস্ট্রির মাথা হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন মানতে অসুবিধা আছে । কিন্তু ওই একই দলের রাজ চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নিলে মানতে রাজি আছি । কারণ তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন । আমরা মানতে বাধ্য ওঁর কথা । তিনি সিনেমাটা বোঝেন । এই মুহূর্তে আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সক্রিয় ভূমিকাতে নেই । একজন শিল্পী হিসেবে বললাম কথাগুলো ।"
রূপা এ দিন আরও জানান, "যে সময়ে আমি সক্রিয় রাজনীতি করছি সেই সময়ে লীনাদি আমাকে দিয়ে 'নকশি কাঁথা' করিয়েছেন । লীনাদি এবং ভরত কল শাসক দলের হয়েও আমাকে ডেকে কাজ দিয়েছেন । তাঁরা যোগ্যতা দেখেন, দল নয় । সুশান্ত দাসও যোগ্যতা দেখেন । তাই রিমঝিম, কাঞ্চনা কাজ করেছে দাপিয়ে । কাজ কারা দেননি ? যারা শাসক দলের নন, তাঁরা ভেবেছেন বিরোধী দলের সমর্থক অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করালে যদি আর কাজ না করতে পারি ? কোভিডের পর মানুষের মনে ভয় ভীষণ রকম ৷ সবাই ভাবছে আমার নিজের কাজটা থাকলেই হল । বাকিদের যা খুশি হোক । শাসক দলের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে আমার আপত্তি নেই, শাসক দলের সমঝদারিতে আমার আপত্তি । এখন মানুষ দিশেহারা । ভাবছে শাসক দলের হয়ে কথা বললে কাজ পাব নাকি বিরোধী পক্ষ হলে কাজ পাব নাকি নিজের একটা টিম তৈরি করলে কাজ পাব ? লবি চিরকাল ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল । কমফর্ট জোনে কাজ করতে কে না চায় ? তবে, কিছু সংখ্যক অভিনেতা একটি প্রযোজনা সংস্থায় পরের পর সিরিয়াল করেই চলবে, আরেক দল অভিনেতা সিনেমা করেই চলবে, তাহলে বাকিরা কী করবেন ? যাঁরা কাজ জেনেও কাজ পাচ্ছে না । কিছু কিছু সংস্থা নির্দিষ্ট কিছু অভিনেতাকে দিয়ে পরের পর ছবি বানায় । সেই তালিকা থেকে বেরোতে পারে না । অনীক দত্তর 'অপরাজিত'র অপু থুড়ি জিতু কমল প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনিও পারেন বক্স অফিস কাঁপাতে । এই সব জিতুদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে কেউ সাহস পায় না । সাহস পেলেন অনীকদা । এই ছবি সবের ঊর্ধে উঠে প্রমাণ করে দিয়েছে । হ্যাটস অফ অনীকদা'কে । মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো অনীকদা'র 'অপরাজিত'। ক্যামেরার সামনে যে ক্যামেরার পিছনে যে প্রত্যেকে এই ছবিতে স্টার ।
আরও পড়ুন: Bengali Serial Lalkuthi : নতুন রহস্যের জট পাকাচ্ছে না কি 'লালকুঠি'র অন্দরে কী বলছেন চরিত্ররা ?
রূপার কথায়, "আজকাল অনেকেই ছবি ফ্লপ করলে বলে দর্শক নেননি ছবিটা । আরে বাবা, দর্শক কি বোকা ? নিল তো সাদা কালো 'অপরাজিত'কে । সবার আগে আমাদের দর্শকের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে । মানুষ জানে কোন চালে বিরিয়ানি ভাল হয় আর কোন চালে হয় না । তাই সেও আজকাল বেছে বেছে ছবি দেখে । তাকে আর যাই হোক স্টারডমের খেলা দেখিয়ে যা হোক কিছু মুখে ঠুসে দেওয়া যায় না । একটা নাম বলুন তো এই ইন্ডাস্ট্রির, যাঁর নামে টিকিট বিক্রি হয় ? দর্শক ইমোশন বোঝে । সঠিক গল্প ভালোবাসে সে । থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় সে আর ভালোবাসে না । ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খুব খারাপ ৷ সবাই মিলে বাঁচাতে হবে ইন্ডাস্ট্রিকে ৷ কেউ একা ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে না ৷ ইন্ডাস্ট্রির ছাদটা নড়বড়ে । সবাই মিলে না দাঁড়ালে ভেঙে পড়বে । যাঁদের বলা হয় ইন্ডাস্ট্রির মাথা তাঁরা ব্যবসা দিচ্ছে তো ঠিকঠাক ?"
অভিনেত্রী এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, "হীরক রাজার দেশে ছবিতে একটা সংলাপ আছে, হিতাহিতের বিচার করে কে ? আমি বলব, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে গুণের বিচার করে কে ? তার যোগ্যতা কী ? নিজের পছন্দের, দলের লোক দিয়ে করাক কাজ । অসুবিধা নেই । কিন্তু সে কাজটার যোগ্য কি না সেটা গুণ নির্ধারক জানেন তো ? বোঝেন তো ? যাঁরা ভাল কাজ করছেন তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছে মধ্যমেধাদের ভিড়ে ৷ অভিজ্ঞদের বলা হচ্ছে তাঁকে কাজ করাতে বাজেট বেশি, তাই নতুনদের দিয়ে কাজ করানো হবে । নতুনদের মধ্যেও অনেকে খুব ভাল অভিনয় করেন । সেখানেও সমস্যা । দলের ঘেঁষা না হলে কাজ নেই । অনেকে কাজ বাঁচাতে দলের হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন । ফলে, কাজ থাকছে । তবে, ট্রেন্ড এখন কিছুটা হলেও থিতিয়েছে এটা অস্বীকার করলে চলবে না ।"
পরিচালক-প্রযোজকদের নিয়ে প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, "পরিচালকের যদি মেরুদণ্ডই না থাকে, তিনি যদি প্রযোজকের গোলামি করেন আর প্রযোজক যদি শাসক দলের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপেন, তা সে যে সরকারই হোক, বামফ্রন্ট, তৃণমূল বা বিজেপি, তা হলে আর যা-ই হোক শিল্পচর্চা হবে না এ রাজ্যে ।"