কলকাতা, 22 অক্টোবর : মণ্ডপের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ত মন্ত্রগুপ্তি 'আয়ুর্দ্দেহি যশোদেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে...'। কিন্তু, এবার যেন মন খারাপের বারোমাস্যা । 13 পার্বণে না মাতলেও বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা বাঙালিরা শিকড়ের টানেই মেতে ওঠেন দুর্গা আরাধনায় । আলতায় রাঙা পা, আটপৌরে শাড়ি আর ধুতি-পাঞ্জাবিতে এবার ঘরে বসেই অঞ্জলি দেবেন প্রবাসীরা । হবে না-ই বা কেন ? কোরোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুতে গোটা বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দেশ । তাই সপ্তমীর অকালবোধন থেকে শুরু করে অষ্টমীর অঞ্জলি, সবই এই বছর বাড়িতে বসেই দেখবেন অ্যামেরিকার ডালাসে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা ।
এ বছর 37 বছরে পদার্পণ করল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ডালাস-ফোর্টওয়ার্থের (BADFW) দুর্গাপুজো । চলতি বছর কোরোনার শাসানিতে পুজোটা করা সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে প্রথম থেকেই ছিল আশঙ্কা । পরে ভাবা হয়েছিল, ঘটপুজো করেই হয়ত সারতে হবে এই বছরের পুজো । কিন্তু, পুজো হবে না শুনে সকলেই বিমর্ষ হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত পুজোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অ্যাসোসিয়েশনের তরফে । তবে, কোরোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে প্রতি বছর পুজো দেখতে আসা মানুষগুলো যাতে বাড়িতে বসেই এবার তা দেখতে পারেন তার জন্য সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল মাধ্যমে পুরো পুজোই লাইভ সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা।
কোরোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মানুষকে সুরক্ষিত রেখে কীভাবে পুজো করা যায় প্রথম থেকেই তা অগ্রাধিকার পেয়েছিল তাঁদের পুজোর প্রস্তুতিতে । সেই কারণে পুজোর স্থান ঠিক করার পরেই এবছর দুর্গাপুজো করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় BADFW । রিখি মজুমদার বলেন, "আমরা আমাদের ভেনু যখন ঠিক করি, যেখানে আমরা পুজোটা করতে পারব, মানুষকে সব সিটি নর্মস মেনে অ্যাকোমোডেট করতে পারব, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা পুজো করব । তারপরেই আমরা প্যান্ডেল তৈরির কাজ শুরু করি ।" প্যান্ডেলও বাইরের কেউ নয়, অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরাই একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছেন সেই মণ্ডপ । রিখি মজুমদার বলেন, "ভেনুর মধ্যে একটা মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে । সেই মণ্ডপ তৈরির কাজ বাড়িতে বাড়িতে হয়েছে । এখানে ইঞ্জিনিয়ার্স আর অন অ্যাকশন । সবাই মিলে কার্পেন্টারির কাজের এক্সপেরিয়েন্স করেছেন । পার্থেননের মতো সাদা রঙের একটা মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে । খানিকটা একটি গ্রিক মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ । তার মধ্যে এথনিক কাজ রাখা হচ্ছে যাতে বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকে । সবাই একসঙ্গে বাড়িতে এসে বসে আড্ডা দিতে দিতে হয়েছে মণ্ডপ তৈরির কাজ ।"
সপ্তাহান্তে হয় ড্যালাসের এই দুর্গাপুজোটি । এবছরও 23 ও 24 অক্টোবর হবে পুজো । শুক্রবার 23 অক্টোবর সন্ধে সাড়ে 6টা থেকে রাত 9টা পর্যন্ত হবে বোধন, মহাষষ্ঠী ও মহাসপ্তমীর পুজো । শনিবার 24 অক্টোবর সারাদিন ধরে মহাঅষ্টমীর পুজো, অঞ্জলি, মহানবমী, মহাদশমীর পুজো, ধুনুচি নাচ, সন্ধ্যা আরতি হবে । পুরো পুজোটাই যাতে মানুষ বাড়িতে বসে দেখতে পারেন তার জন্য স্থানীয় একটি মিডিয়ার সঙ্গে কোলাবরেশন করেছে BADFW । সেই চ্যানেল ও তার অ্যাপে পুজো লাইভ দেখা যাবে । অষ্টমীর অঞ্জলিও এবার বাড়িতে বসেই দিতে হবে প্রবাসের বাঙালিদের । রিখি মজুমদার বলেন, "আমরা এবার লোকজনকে পুজো দেখতে আসতে দিতে পারছি না । মানুষ রোজ নিজের বাড়ির ঠাকুরকে প্রণাম করেন । এবার ফোনে অ্যাপে পুজোটা দেখতে পাবেন এবং নিজের বাড়ির বাগানের ফুল তুলে নিজের বাড়ির ঠাকুরের পায়ে দুর্গাপুজো দেখতে দেখতে অঞ্জলি দেবেন । অন্য কেউ মণ্ডপে অঞ্জলি দেবেন না । আমরা কাউকে কষ্ট দিতে চাই না । তাই কোনও ডিসক্রিমিনেশন রাখছি না ।"
এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে পুজোর মাঝের সময়ে । সেখানে যেমন কোরোনা প্যানডেমিকে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করা চিকিৎসক, নার্সদের জন্য অনুষ্ঠান থাকবে, তেমনি এবছর গ্রাজুয়েশন পার্টি থেকে বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের জন্যেও অনুষ্ঠান থাকবে । থাকবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিভিন্ন শিল্পীদের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান । এমনকি ভার্চুয়াল ফ্যাশন শো-এরও আয়োজন করা হয়েছে । যাতে পুজোর প্রত্যেকটা মুহূর্তের আনন্দ বাড়িতে বসেই নিতে পারেন মানুষ । থাকছে খিচুড়ি, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, পায়েস, পাপড় ভাজা সহযোগে অষ্টমীর ভোগ । তবে, একটু অন্যভাবে । রিখি মজুমদার জানাচ্ছেন, "একটি রেস্টুরেন্ট যারা প্রতি বছর এই ভোগ বানায় তাঁদের জন্য, এই বছর রেস্টুরেন্টেরই টেক-আউট হিসেবে অষ্টমীর দুপুরে এই মেনু রাখছে তাঁদের অনুরোধে । ওইদিন যাদের ভোগ নিতে ইচ্ছে হবে তাঁরা সরাসরি সেই ভোগ অর্ডার করে আনিয়ে নিতে পারবেন বিভিন্ন হোম ডেলিভারির অপশন ব্যবহার করে ।"
ভার্চুয়াল মানে কি একেবারেই দুর্গা মায়ের দর্শন করতে পারবেন না কেউ ? না, তা নয় । পুজো বাড়িতে বসে দেখতে হলেও 25 অক্টোবর সশরীরে মণ্ডপ ও প্রতিমা দর্শনের সুযোগ পাবেন ইচ্ছুক মানুষরা । তার জন্য থাকছে অনলাইনে বুক করার ব্যবস্থা । ইচ্ছুকরা এক ঘন্টার টাইম স্লট বুক করে নিতে পারবেন আগে থেকেই । বুকিংয়ের কনফার্মেশনও আগে থেকেই পেয়ে যাবেন তাঁরা। মণ্ডপের ভিতরে এক সময়ে সর্বোচ্চ 10 জন থাকবেন । তাই এক ঘন্টার স্লটে 50 জনের বুকিং করানো হবে । তাঁরা এসে সামাজিক দূরত্ব মেনে লাইন দিয়ে ঢুকে মণ্ডপ ও প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন । থাকবে তাপমাত্রা পরীক্ষার যন্ত্র, মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ারের ব্যবস্থাও । আবার কেউ যদি ভিতরে ঢুকতে না চান তাহলে কাচ দিয়ে মোড়া ভেনুর বাইরে থেকেই দেখে চলে যেতে পারবেন । গাড়িতে যেতে যেতেও দেখে নিতে পারবেন কেউ চাইলে । এই সবদিক মাথায় রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে পুজোর জায়গা ।