শিলিগুড়ি, 3 মার্চ: রাত একটা হোক বা দিনের ঝলমলে আলো- কখন ডাক পড়বে জানে না কেউ ৷ নিষিদ্ধ পল্লির অন্ধকার গলি ঘুরে উদ্ধার করে আনেন পাচার হয়ে যাওয়া বিভিন্ন রাজ্যের যুবতিদের ৷ তবে কাজ এখানেই শেষ হয়ে যায় না ৷ তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়া থেকে শুরু করে থাকার ব্যবস্থা বা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ- সব কিছুতেই হাত বাড়িয়েদেন ৷ তিনি রঙ্গু সৈরিয়া ৷ শিলিগুড়ির প্রত্যন্ত পানিঘাটা এলাকার বাসিন্দা রঙ্গু মহিলা পাচার চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন একাই ৷
রঙ্গুর শৈশব কেটেছে পানিঘাটার এক চা বাগানে ৷ ছোট বয়স থেকেই দেখেছেন মহিলা চা শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ৷ প্রতিদিন দেখেছেন ঘরে ঘরে অর্থের অভাব, অনটন আর অকথ্য অত্যাচার । সেই থেকেই তার মাথার মধ্যে ঘুরছিল অসহায় নিপীড়িত মহিলাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা । বিএড পাশ করার পর উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং নেপাল থেকে শিলিগুড়ি হয়ে যে মহিলা-পাচার চক্র কাজ করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি । শুভানুধ্যায়ী এবং সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে 2004 সালে গড়ে তোলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র । নারী পাচার বিরোধী আন্দোলনের বলিষ্ঠ মুখও তিনি ।
রঙ্গু ও তার সহকারীদের মূল কাজ হল নারী পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা এবং কোনও সূত্র পেলেই তা যাচাই করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লি থেকে মহিলাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে যান । বিষয়টি শুনতে সহজ মনে হলেও কাজটা অত্যন্ত কঠিন । বিশেষ করে মহিলাদের উদ্ধার করা গেলেও তাদের মূল স্রোতে ফেরানোর কাজটা হয়ে ওঠে আরও কঠিন । বহু ক্ষেত্রেই উদ্ধার করা মেয়েদের বাড়ি ফেরাতে চায় না পরিবার । আক্ষেপ করে রঙ্গু সৌরিয়া বলেন, ''উত্তরবঙ্গের একমাত্র কোচবিহারে সাবালিকাদের জন্য হোম রয়েছে । সেখানেও উপচে পড়া ভিড় । কাউকে উদ্ধার করার পর তার পরিবারের কাছে ফেরানো না গেলেই সমস্যা ৷
রঙ্গু জানিয়েছেন, একদিকে প্রলোভন, অন্যদিকে সোশাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার হাতছানি ঘর থেকে বার করে আনছে কিশোরী এবং যুবতিদের । পাচার করার পিছনে কাজ করছেন তাদেরই পরিচিত লোকজন, যাদের সে নিজের নিকটতম ভেবে এই ফাঁদে পা দেয় । যতক্ষণে সে বুঝতে পারছে, যে তাকে পাচার করা হচ্ছে, তখন আর কিছুই করার থাকে না । শুরু হয় তাদের দাসত্বের জীবন ৷ প্রতিদিন চলে যৌন উৎপীড়ন ৷
গত এক দশকে প্রায় তিন হাজারের বেশি মহিলাকে উদ্ধার করেছেন রঙ্গু সৌরিয়া ও তার সহকর্মীরা । পাচার হওয়া যুবতি ও মহিলাদের উদ্ধার করতে ছুটে গিয়েছেন দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা বা ভিন রাজ্যের বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লিতে । উদ্ধার কাজে সফল হয়ে ফিরে আসার পর প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ দিলেও কিছু ক্ষেত্রে সফলতা মেলেনি । সে ক্ষেত্রে কেউ লোকলজ্জার ভয়ে, পেটের জ্বালায় বেছে নেন আত্মহত্যার পথ । এই নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে রঙ্গুর । তাই তিনি চান, পাচার হওয়া মহিলাদের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবুক সরকার, করা হোক সঠিক পদক্ষেপ । নারী পাচার রুখতে আগামী দিনেও এভাবেই কাজ করে যেতে চান রঙ্গু ।