মালদা, 26 অগস্ট : কলকাতা রাজধানী হলেও মালদা (Malda) জেলাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য চালাত ইংরেজরা। বিশেষত নীলচাষ ও তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের প্রধান কেন্দ্র ছিল এই জেলা । একাধিক নীলকুঠির অস্তিত্ব এখনও রয়েছে সেখানে ৷ নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য 1902 সালে মালদা শহরে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা । তার নাম ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব । সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল না । 1947 সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউরোপিয়ান ক্লাবের নামেও বদল আসে । তার নতুন নাম হয় মালদা ক্লাব । কিন্তু স্বাধীনতার পরেও ওই ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকারে নানাবিধ বিধিনিষেধ ছিল। 1950 সালে মালদার দ্বিতীয় জেলাশাসক রঞ্জিত ঘোষ প্রথম দেশীয় ক্লাব তৈরি করেন । নাম দেওয়া হয় অফিসার্স ক্লাব । স্বাধীনতার পর প্রশাসনিক কর্তারা উদ্বাস্তু সমস্যা মেটাতে জর্জরিত ছিলেন । সারাদিনের কাজের চাপ সামলে মনোরঞ্জনের জন্যই ওই ক্লাব তৈরি করা হয় । পরবর্তীতে এই ক্লাব মালদা শহর তো বটেই, জেলারও একটি পরিচিতি হয়ে উঠেছিল । আধুনিকীকরণের নামে সেই ক্লাব এখন মাটিতে মিশে যাচ্ছে । পুরোনো সেই ক্লাবঘর ভেঙে নতুন ঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন । এনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলার বিদ্বজ্জনেরা।
দীর্ঘদিন ধরে মালদা জেলার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন প্রাক্তন শিক্ষক ও সাংবাদিক মহম্মদ আতাউল্লাহ্ । তিনি বলেন, “আমার যতদূর জানা আছে, 1950 সালে তৎকালীন জেলাশাসক রঞ্জিত ঘোষ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি নিজে ফুটবল খেলতেন, রেফারিও ছিলেন । সেই সূত্রে তিনি এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানে খেলার পরিবেশও খুব ভাল ছিল । ক্লাবটি ছিল দ্বিতল । উপরের তলটি সবসময় জমজমাট থাকত । ক্লাবের নিজস্ব ফুটবল দলও ছিল । সেই দলে যাঁরা খেলতেন, তাঁরাও ছিলেন স্বনামধন্য খেলোয়াড় । এছাড়া ক্লাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হত । সেই সময় ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল সাহেবদের জন্য নির্দিষ্ট । জেলা স্বাধীন হওয়ার পর অফিসার্স ক্লাবই প্রথম দেশীয় ক্লাব । সেই ক্লাব ভেঙে ফেলা হচ্ছে জেনে মর্মাহত হলাম । এই ভবন ভাঙার প্রয়োজন ছিল না । বরং পুরনো ভবনকেই সংস্কার করা উচিত ছিল । বাইরে থেকে আসা মানুষ এই শহরের একটি ঐতিহ্য আর দেখতে পাবেন না । খুব খারাপ লাগছে ।”
আরও পড়ুন : physical training camp chanchal : চাঁচলের ছেলেমেয়েদের সেনায় সুযোগ করে দিতে প্রশিক্ষণ শিবির সেনা কমান্ডো’র
বঙ্গরত্ন সম্মানপ্রাপ্ত প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ইংরেজবাজার পৌরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য শক্তিপদ পাত্র ঘটনাটি জেনে স্তম্ভিত । তিনি বলেন, “এই ঘটনার কথা শুনে আমার ইএম ফস্টারের লেখা ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সেখানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্লাবের উল্লেখ ছিল । সেটা ব্রিটিশ শাসকদের ক্লাব ছিল । সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল না । আমার ধারণা, তেমনই একটি আবহে দেশীয় অফিসার্স ক্লাব তৈরি হয়েছিল । তৎকালীন জেলাশাসক এই ক্লাব তৈরি করেন । জানতে পারলাম, সেই ক্লাব ভবন নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে । হয়তো নথিপত্রে এই ভবন হেরিটেজ নয়, কিন্তু আমি মনে করি, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে কোনও সম্পত্তিই হেরিটেজ । তাই আমার মনে হয়, পুরনো ভবনের আঙ্গিক বজায় রেখে, তার সংস্কার করলে এই জেলার একটি পুরনো স্মৃতি বজায় থাকত । এটা মালদার সম্পদ হতে পারত । এই জেলার পর্যটনে ভবনটু একটি বিশেষ জায়গা নিতে পারত ৷ প্রশাসনের উদ্দেশ্য কী, আমি জানি না । কিন্তু, এই ভবনের পুরনো আঙ্গিক বজায় রেখে সংস্কার করা হলে আমরা গর্বিত হতাম । তাজমহলও তো অনেক পুরনো । সেটির সংস্কার করা হচ্ছে । কিন্তু, প্রাচীন বলে কি তাজমহলকে ভেঙে নতুন করে গড়া হচ্ছে ?”
আরও পড়ুন : Afghanistan-Dry Fruit : আফগানি হিং-ড্রাই ফ্রুটের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা বিক্রেতাদের
যদিও এসব বিষয়ে আমল দিতে নারাজ জেলা প্রশাসন । সদর মহকুমা শাসক সুরেশচন্দ্র রানোকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এই ক্লাবটি মালদা জেলা প্রশাসনের অফিসারদের ক্লাব ছিল। একসময় এই ক্লাবঘর ব্যবহারও হত । কিন্তু, 15-20 বছর ধরে এই ক্লাব ব্যবহার করা হয়নি । সেটি পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ির আকার ধারণ করেছিল। দু’একজন ক্লাবের জায়গা জবরদখলও করে বসেছিল ৷ দোকানপাট তৈরি হয়েছিল ৷ রাজ্যের প্রতিটি জেলায় অফিসার্স ক্লাব রয়েছে ৷ কিন্তু মালদায় তা ছিল না। তাই ওই জায়গায় নতুন একটি অফিসার্স ক্লাব তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা সমস্ত ধরনের অনুমতি নিয়েই এই কাজে হাত দিয়েছি । ওই ক্লাব ভবনটি অবশ্যই পুরনো ৷ কিন্তু সেটি হেরিটেজ ভবন হিসাবে চিহ্নিত ছিল না। ব্যবহার না হওয়ায় ভবনটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নতুন ভবনে অফিসাররা সময় কাটাতে পারবেন। ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা থাকবে। নীচের অংশে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যে কোনওদিন নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে ।”