মালদা, 22 ডিসেম্বর : 'দিদিকে বলো'-তে কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ জানিয়ে বিপাকে ছ'জন গ্রামবাসী ৷ প্রশাসন কিংবা দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কতটা, মূলত তা জানতেই নির্বাচনী পরামর্শদাতার কথা অনুযায়ী 'দিদিকে বলো' কর্মসূচি চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ দলীয় কর্মসূচি হলেও তিনি যে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই সাধারণ মানুষের অভিযোগ শুনতে এই ব্যবস্থা চালু করেছেন, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি কারোর ৷ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে অভিযোগ জানানোর সুযোগ পেয়ে স্বস্তি পেয়েছিল সাধারণ মানুষ ৷ অনেকেই 'দিদিকে বলো'-র নম্বরে ফোন করে নিজেদের অভিযোগ জানিয়েছে ৷ ফলও পেয়েছে অনেকে ৷ এক ফোনেই সমস্যা সমাধানে, বিষয়টি মানুষের কাছে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে ৷ কিন্তু 'দিদিকে বলো'-য় ফোন করে অভিযোগ জানিয়ে যে চরম ফ্যাসাদে পড়তে হতে পারে তা জানা ছিল না কারোর ৷ কিন্তু তেমনই ঘটনা ঘটেছে ৷ এলাকার তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছেন মালদার রতুয়া 2 নম্বর ব্লকের পীরগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছ'জন ৷ এদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই জেলে ৷ গ্রেপ্তারি এড়াতে বাকি পাঁচজন এই মুহূর্তে ঘরছাড়া ৷ অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা যদিও নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করছেন ৷ তবে ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ৷
দীর্ঘদিন ধরেই তৃণমূল পরিচালিত পীরগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাটমানি আদায়ের অভিযোগ উঠেছিল ৷ অভিযোগ, 100 দিনের কাজ প্রকল্পে জবকার্ডধারীদের কাছ থেকে কাটমানি আদায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন পঞ্চায়েত সদস্যদের একাংশ ৷ তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য আবু সুফিয়ান ওরফে বুলেটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল 100 দিনের কাজ প্রকল্পে জবকার্ডধারীদের কাছ থেকে কাটমানি আদায় করেছেন ৷ শুধু তাই নয়, সরকারি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির টাকা যে সব মহিলা উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে, তাদের কাছ থেকেও তিনি 15 থেকে 20 হাজার টাকা জোর করে আদায় করছেন ৷ এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানান পীরগঞ্জ গ্রামের ছয় বাসিন্দা ৷ কিন্তু কোনও কাজ হয়নি ৷ তাঁরা 'দিদিকে বলো'-তে ফোন করে নিজেদের অভিযোগ জানান ৷ যার জেরে তাঁরা শাসকদলের একাংশের রোষে পড়েন ৷
'দিদিকে বলো'-তে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেই ভুয়ো জবকার্ড তৈরির অভিযোগ দায়ের হয় স্থানীয় পুকুরিয়া থানায় ৷ অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় মহম্মদ স্টালিন নামে একজনকে ৷ বাকি পাঁচজন গ্রেপ্তারি এড়াতে গত দু'সপ্তাহ ধরে ঘরছাড়া ৷ গ্রামবাসীদের বক্তব্য, এই ছ'জনের বিরুদ্ধে আনা ভুয়ো জবকার্ড তৈরির অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যে ৷ তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যের বিরুদ্ধে 'দিদিকে বলো'-তে অভিযোগ জানানোর জন্যই তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ৷
একজন অভিযোগকারী বদিরুদ্দিন শেখ বলেন, "100 দিনের কাজ প্রকল্পে উদ্যানপালন দপ্তরের অধীনে বেড়া তৈরির কাজ ছিল ৷ 78 টি বেড়া তৈরির কথা থাকলেও 30টির বেশি তৈরি হয়নি ৷ সেই কাজ করে যে 2 হাজার টাকা পেয়েছে, তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে পঞ্চায়েত সদস্য আবু সুফিয়ান ৷ অর্থাৎ পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা তাঁকে দিতে হচ্ছে ৷ কারোর ঘর তৈরির জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা কারোর অ্যাকাউন্টে ঢুকলে পঞ্চায়েত সদস্যরা সেখান থেকে 20 হাজার টাকা নিয়ে নিচ্ছে ৷ কাটমানি না দিতে চাইলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে ৷ এ সব দেখে আমি নিজে 'দিদিকে বলো'-তে ফোন করে গোটা ঘটনা জানাই ৷ তারজন্যই আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ৷ এখন আমরা আতঙ্কে রয়েছি ৷ গত 14 দিন ধরে বাড়িতে থাকতে পারছি না ৷"
আরও এক অভিযোগকারী মোকতারুল শেখ বলেন, "এখানে উদ্যানপালন বিভাগের 78 টি বেড়ার মধ্যে 30টি বেড়া তৈরি হয়েছে ৷ কিন্তু 65 টি বেড়ার টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে ৷ এই কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রায় 150 জন শ্রমিক ৷ সেই শ্রমিকদের মজুরির অর্ধেক টাকা আবু সুফিয়ান নিয়ে নিচ্ছে ৷ 20 হাজার টাকা নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার উপভোক্তাদের কাছ থেকেও ৷ এ সব নিয়ে আমরা 'দিদিকে বলো'-তে অভিযোগ জানাই ৷ তারজন্যই আমাদের বিরুদ্ধে পুকুরিয়া থানায় মিথ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ৷ পুলিশ ইতিমধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে ৷ আমাদেরও হেনস্তা করছে ৷ পুলিশের ভয়ে আমরা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি ৷" একই বক্তব্য মতিউর রহমান ও মহম্মদ সামিরুদ্দিনেরও ৷ পুলিশের ভয়ে তাঁরাও এখন লুকিয়ে রয়েছেন ৷
এ প্রসঙ্গে এক গ্রামবাসী সিতারা বেওয়া বলেন, "100 দিনের কাজে আমার অ্যাকাউন্টে 3 হাজার টাকা ঢুকেছিল ৷ পঞ্চায়েত সদস্য আমার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়েছে ৷ আমার ছেলের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছিল 2700 টাকা ৷ তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়েছে ৷ ৩ নম্বর সংসদের তৃণমূল সদস্য বুলেট এই টাকা নিয়েছে ৷ আমরা জানি, বুলেটের এই কাজকর্মের বিরুদ্ধে গ্রামের কয়েকজন দিদির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল৷ প্রতিবাদ করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা করা হয়েছে ৷ পুলিশের ভয়ে তাঁরা এখন বাড়িতে থাকতে পারছেন না ৷"
যদিও অভিযুক্ত পঞ্চায়েত সদস্য আবু সুফিয়ানের সাফাই, "এ সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে ৷ অভিযোগের ভিত্তিতে BDO এখানে তদন্ত করতে লোক পাঠিয়েছিলেন ৷ তদন্তে আমার বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি ৷" এ দিন ছুটি থাকায় রতুয়া 2-এর BDO-র সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি ৷ গোটা ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে অস্বীকার করেছে পুকুরিয়া থানার পুলিশও ৷ তবে পীরগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান মইনুর বিবি গ্রামবাসীদের হেনস্তার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ৷ তিনি বলেন, "100 দিনের কাজ প্রকল্পে কাটমানি আদায়ের অভিযোগ আমি শুনেছি ৷ তৃণমূলেরই পঞ্চায়েত সদস্য আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ উঠেছে ৷ তবে কত টাকা কাটমানি নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে তা আমি জানি না ৷ এক্ষেত্রে সরকারি আইন অনুযায়ী আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে ৷"