কলকাতা, 5 এপ্রিল : রাজ্যের যে অংশের ভোটাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম ভরসাস্থল, তাঁরা কি এবার তৃণমূল নেত্রীর প্রতি রুষ্ট হয়ে পড়ছেন ? রাজ্যে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনার জেরে এই প্রশ্নই বারবার উঠছে বঙ্গের রাজনৈতিক মহলে ৷ তাহলে কি মমতার ভোটব্যাঙ্কে এবার ভাঙন আসন্ন (will mamata banerjee loose her minority vote bank) ?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সংখ্যালঘুরা বরাবরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ভরসা করেন ৷ বিশেষ করে 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই ভরসা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে ৷ তার জেরেই মমতার বঙ্গ-জয়ের হ্যাটট্রিকের পথ সুগম হয়েছে ৷ কিন্তু সেই জয়ের বছর ঘোরার আগেই সাম্প্রতিক কালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Bengal Chief Minister Mamata Banerjee) পুলিশ, প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুরাই সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন ৷
প্রথমে আনিশ খান হত্যাকাণ্ড, তারপর বীরভূমের বগটুইয়ে বেশ কয়েকজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা, আর এখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (Aliah University) উপাচার্য নিগ্রহের ঘটনায় প্রশ্নের মুখে মমতার সরকার এবং দল তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) ৷ ফলে বারবার সংখ্যালঘুদের পথে নামতে দেখা যাচ্ছে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে ৷ এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা ৷
যা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল মুখোপাধ্যায়ের মতে, এমনটাই হওয়ার ছিল । এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সামগ্রিক উন্নয়ন না করে শুধু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে এই সরকার । আস্তে আস্তে হলেও সেই ভুল ভাঙছে মানুষের । তাই বিপরীত স্রোত অল্প হলেও দেখা যাচ্ছে । রাজ্য সরকার যদি সংখ্যালঘু মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন না করে তাহলে এই স্রোত আরও লম্বা হবে ৷’’
অন্যদিকে রাজ্যের সংখ্যালঘু বিধায়ক তথা আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকী বলছেন, ‘‘কোনও সম্প্রদায়কে ভোটব্য়াঙ্ক হিসেবে দেখলে তার প্রকৃত উন্নয়ন করা যায় না । মানুষকে তার অধিকার প্রদান করতে হয় ।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সময় তৃণমূল সরকার সংখ্যালঘু মানুষদের কাছে যে প্রতিশ্রুতিগুলো করেছিল, তার একটিও পূরণ করতে পারেনি । অথচ এই সরকার সংখ্যালঘুদের এনআরসি-সিএএ-এর ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘু ভোট নিয়েছে ।’’
এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন তিনি । নওশাদের অভিযোগ, ‘‘এই সরকার সংখ্যালঘুদের ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় । তাদের প্রকৃত উন্নয়ন করতে চায় না । এখন সব ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের চোখ কান খুলেছে । তাঁরা বুঝতে পারছেন প্রকৃত সত্য । তাই আগামিদিনে কী হবে, সেটা বলা মুশকিল ।’’
একই ভাবে সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের নেতা মহম্মদ কামারুজ্জামান বলেন, ‘‘রাজ্যে সংখ্যালঘু জ্ঞানী ভাল মানুষ যে নেই, এমন নয় । অথচ রাজ্যের শাসকদল তাদের নেতা হিসাবে তুলে আনছে যারা বাহুবলী, যারা বিভিন্ন জায়গায় গুন্ডাগিরি করে । আসলে এসবের মাধ্যমে এমন চিত্র সামনে আসছে, যেন সংখ্যালঘু নেতা মানে আনারুলের মতো । এই ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বদনাম করার একটা চক্রান্ত চলছে ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘বাংলার সংখ্যালঘুরা প্রচুর আশা এবং প্রত্যাশা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সরকারে এনেছে । কিন্তু এই সরকার মানুষের উন্নয়ন শিক্ষা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ । তাই কারও কারও মোহভঙ্গ হচ্ছে এখন । সেই ছবি দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে ।’’
কামারুজ্জামানের কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে সংখ্যালঘু যুবক-যুবতীদের নিজের ভাল বুঝে নিতে হবে । তার মানে এই নয় যে নতুন রাজনৈতিক দল করার প্রয়োজন রয়েছে । তারা সচেতন হলেই এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে ।’’
এদিন এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বেশ সাবধানী নাখোদা মসজিদের ইমাম মাওলানা সফিক কাসেমি । তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘সরকার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নিলেও সব দায় সরকারের নয় । এখানে সংখ্যালঘুদেরও দায় রয়েছে । আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে বলতে হয় দীর্ঘদিনের দাবি মেনে সরকারের তরফ থেকে একটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল । তার পরিবেশ ভাল রাখার দায়িত্ব আমাদের । এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সকলকেই তাঁর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে হবে । এই দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে বর্তমানে সংবাদমাধ্যমে যা শোনা যাচ্ছে, এমন ঘটনা ঘটবে না ।’’
এদিন আইন-শৃঙ্খলা নিয়েও নাগরিকের দায়িত্ব পালনের কথা বলেন তিনি । এক্ষেত্রে বগটুই কাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে আনেন নাখোদা মসজিদের ইমাম । তিনি বলেন, ‘‘রামপুরহাটে যেভাবে পঞ্চায়েতের উপপ্রধানকে মারা হল, তাও যেমন ঠিক নয় একই ভাবে ঠিক নয়, আগুন লাগিয়ে কারও জীবন নেওয়া । এক্ষেত্রে আমাদের (নাগরিকের) সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে ।’’
এদিন এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তিনি দাবি করেছেন, আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর উচিত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা । যারা 15 দিন অন্তর তৃণমূল স্তরের রিপোর্ট তাঁকে দেবেন । তিনি মনে করছেন, বহু ঘটনা সম্পর্কে তথ্য মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া হচ্ছে না । তাঁর চারপাশে যে সরকারি আধিকারিকরা রয়েছেন, তারা বহু ক্ষেত্রে তাঁকে বিভ্রান্ত করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি । তাই তাঁর মতে, আর এর জন্যই প্রয়োজন এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি ।