কলকাতা, 10 অক্টোবর : ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, এখন থেকে স্নাতকোত্তর স্তরে ট্রেনি ডাক্তারদের তিন মাস বাধ্যতামূলক জেলার হাসপাতালগুলিতে কাজ করতে হবে । জেলাগুলিতে পর্যাপ্ত ডাক্তারের অভাব বরাবরই একটি বড় সমস্যা বাংলায় । কমিশনের এই নির্দেশিকা যথাযথভাবে পালন হলে, জেলায় ডাক্তারের অভাব সংক্রান্ত সমস্যা অনেকটাই মিটবে বলে আশা । এই সিদ্ধান্তের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সাধুবাদও জানানো হয়েছে কমিশনকে ।
তবে একইসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্নচিহ্নও উঠে আসছে । চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, এভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় । তাঁদের মতে, জেলাস্তরে সরকারি হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামোগত যে সব খামতি রয়েছে, সেগুলি আগে দূর করা প্রয়োজন । স্নাতকোত্তর স্তরে ট্রেনি ডাক্তাররা জেলায় গিয়ে যদি কাজ করার পরিবেশ এবং যথাযথ পরিকাঠামো না পান, তাহলে এই উদ্যোগ কেবল লোক দেখানো হয়েই থেকে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা ।
মেডিকেলে স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি তিন মাসের 'রুরাল পোস্টিং' অর্থাৎ, জেলার হাসপাতালগুলিতে গিয়ে কাজ করা বাধ্যতামূলক করেছে । সরকারি এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পরামর্শদাতা, চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ । তাঁর কথায়, "আমাদের দেশে গ্রাম এবং শহরে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য আছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই বৈষম্য কিছুটা হলেও হয়ত কমবে ।"
কিন্তু কী এই বৈষম্য? তিনি বলেন, "আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ চিকিৎসক, ৭৫ শতাংশ ডিসপেনসরি এবং, ৬০ শতাংশ হাসপাতাল রয়েছে শহরাঞ্চলে । গ্রাম অঞ্চলে রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ চিকিৎসক, ২৫ শতাংশ ডিসপেনসরি এবং ৪০ শতাংশ হাসপাতাল । তিন মাসের বাধ্যতামূলক 'রুরাল পোস্টিং'-এর সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ডাক্তারদের নিযুক্ত করা হবে জেলা হাসপাতালগুলিতে । এর ফলে বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে বলে আমার বিশ্বাস ।" তবে সবার আগে জেলাস্তরে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন আনা দরকার বলে মনে করছেন তিনি ।
সরকারি পদক্ষেপকে সমর্থন জানালেও, পরিকাঠামোগত খামতির কথা স্বীকার করেছেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পরামর্শদাতা । রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন, সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "আমাদের রাজ্যে বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় যে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরিষেবা দেওয়ার মতো অবস্থা 90 শতাংশ জায়গায় নেই । " তিনি আরও বলেন, "এই পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ভালো । কিন্তু ভালো তখনই হবে, যখন এই চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যাবে । " এ রাজ্যের গ্রামীণ এবং জেলা স্তরের হাসপাতালগুলিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ প্রায় 90 শতাংশ ফাঁকা রয়েছে । যথাযথ পরিকল্পনা এবং পরিকাঠামোর অভাব থাকলে তিন মাসের জন্য পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ডাক্তারদের জেলা স্তরে পাঠানোর সরকারি এই পরিকল্পনার অপব্যবহার হবে বলেও মনে করছেন সজল বিশ্বাস ।
এ রাজ্যে বর্তমানে কত চিকিৎসক এবং নার্স রয়েছেন?
জেলা স্তরে নার্সিং স্টাফের সংখ্যা খুব কম রয়েছে । হাসপাতালের বেড এবং নার্সিং স্টাফের মধ্যে যে অনুপাত, জেনেরাল ওয়ার্ডে 10টি বেড পিছু একজন করে নার্সিং স্টাফ, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ওয়ার্ডে প্রতি বেড পিছু একজন করে নার্সিং স্টাফ থাকার কথা । কিন্তু এমন নেই । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ওয়ার্ডেও দেখা যাচ্ছে, 5-6 টি বেডের জন্য একজন করে নার্সিং স্টাফ । জেনেরাল ওয়ার্ডে যেখানে সর্বাধিক 10 জন করে রোগীকে দেখতে পারেন একজন নার্স, সেখানে 50-100 জন রোগীর জন্য একজন করে নার্সকে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে ।
রাজ্যে অ্যাম্বুলেন্সের সামগ্রিক ছবিটা ঠিক কেমন ?
সংক্রমক এবং অসংক্রমক রোগীদের বহন করার জন্য সারা রাজ্যে হাতেগোনা সংখ্যক কিছু অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে উপর সাধারণ মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে ।
COVID-19-এর আগে অপারেশনের দিন পেতে এক মাস, দুই মাস, তিন মাস সময় লেগে যেত । সিটি স্ক্যানের দিন পেতে দেখা গেছে এক মাস সময় লেগে যাচ্ছ । এক্স-রে করার জন্য সাত দিন লেগে যাচ্ছে । USG-র ডেট পেতে তিন মাস সময় লেগে যাচ্ছে । যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, তার এক-তৃতীয়াংশও নেই জেলার বেশিরভাগ হাসপাতালে ।
চিকিৎসক সজল বিশ্বাসের কথায়, জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে সুপার স্পেশালাইজ়ড বিষয় হিসাবে নিউরোলজি, নিউরো সার্জারি, কার্ডিওলজি, এন্ড্রোক্রিনোলজি, নিওনেটালজি এগুলির কোনওটি কোথাও নেই । জেনেরাল সার্জারি, গাইনিকোলজি, অবস্ট্রেট্রিক, চোখ, ENT, এই সব রয়েছে । বেশিরভাগ স্থানে পরিকাঠামো এবং ম্যানপাওয়ারের এত ঘাটতি, দেখা যাচ্ছে, বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয় না ।
চিকিৎসকদের অভাবের ছবিটা কতটা চিন্তার?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্ষেত্রে এক রকমের ঘাটতি, জেনেরাল ডিউটি মেডিকেল অফিসারের ক্ষেত্রে এক রকমের ঘাটতি রয়েছে । স্পেশালিস্টদের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যাচ্ছে, মহকুমাস্তরে 90 শতাংশের বেশি পদ ফাঁকা রয়েছে । জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে 30 শতাংশের বেশি পদ ফাঁকা রয়েছে । জেলা এবং গ্রামীণ স্তরের হাসপাতালগুলিতে 20 শতাংশের বেশি নার্সিং স্টাফের ঘাটতি রয়েছে । COVID-19 এর কারণে এই ছবি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ।
চিকিৎসকদের বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে মহিলা চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "চিকিৎসকদের নিরাপত্তার সমস্যা সব জায়গায় রয়েছে । চিকিৎসকদের উপর আক্রমণের ঘটনা বার বার ঘটছে । সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে নিরাপত্তার সমস্যা আরও বেড়ে যাবে ।"
এক পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি ডাক্তার সৌম্যকান্তি পান্ডা বলেন, "ট্রেনিং চলাকালীন COVID-19-এর কারণে চিকিৎসকদের ট্রেনিং ব্যাহত হচ্ছে, এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে বাড়তি তিন মাস জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলে, অবশ্যই তাদের ট্রেনিং আরও ব্যাহত হবে । " তিনি আরও বলেন, "চিকিৎসকের থাকার জন্য ন্যূনতম জায়গা, বিশুদ্ধ পানীয় জল, 24 ঘণ্টা বিদ্যুৎ, কোনও কিছুরই ব্যবস্থা করা হয় না । গ্রামের হাসপাতালে এবং চিকিৎসকদের জীবনধারণের জন্য যেগুলো প্রয়োজন, সেগুলির দিকেও যদি সঠিকভাবে নজর দেওয়া হয়, তাহলে এটা বোধহয় উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে ।"