কলকাতা, 10 নভেম্বর : অতীতে রাজ্যপালের কার্যকলাপ নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কিন্তু রাজ্যের নবনির্বাচিত বিধায়কদের শপথ নিয়ে বারবার যেভাবে বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে গতকালই মুখ খুলেছেন তিনি । বিধানসভায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, রাজ্যপাল স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চাইছেন ।
কিন্তু এই প্রথম নয়, জগদীপ ধনকর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে আসার পর থেকেই রাজভবন এবং নবান্নের সংঘাত যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমতাবস্থায় অতীতে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির কাছে রাজ্যপালকে অপসারণের জন্য চিঠিও দিয়েছে রাজ্য সরকার । তবু কিছুদিনের বিরতির পর ছাইচাপা আগুনের মতো বারবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে আসছেন রাজ্যপাল । আর সেটাই আজ আলোচনার বিষয় ।
আরও পড়ুন : Amit Mitra: বাণিজ্য সম্মেলন নিয়ে রাজ্যপালের টুইটে ড. জেকিল ও মি. হাইডের ছায়া দেখছেন অমিত
তথ্য বলছে, বাংলায় সৈয়দ নুরুল হাসান থেকে গোপালকৃষ্ণ গান্ধির মতো রাজ্যপাল পেয়েছে, তেমনই এসেছেন বহু রাজ্যপাল যাঁদের সঙ্গে রাজ্যের তথা শাসকদলের সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়েছে ।
1967 সালে রাজ্যপাল ধর্মবীরের সঙ্গে তুমুল সংঘাত বেঁধেছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের । ধর্মবীর অজয় মুখোপাধ্যায়কে তিনদিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলে চিঠি দেন । অজয় মুখোপাধ্য়ায় জবাব দেন, যা হওয়ার তা পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বিধানসভাতেই হবে । চিঠি পেয়ে ধর্মবীর মন্ত্রিসভা বরখাস্তের সুপারিশ পাঠান কেন্দ্রে । বিবাদ চরমে ওঠে । সিপিএমের প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত বাংলার আরেক প্রাক্তন রাজ্যপাল বিডি পাণ্ডের নামই দিয়েছিলেন বাংলা দমন পাণ্ডে ।
আরও পড়ুন : BJP leader expelled : নারদ-প্রসঙ্গ টেনে শুভেন্দুকে খোঁচা, বহিষ্কৃত হাওড়ার বিজেপি নেতা
তবে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ হয়েছিল প্রাক্তন রাজ্যপাল এপি শর্মার মেয়াদে । 1984 সালে এপি শর্মা বাম-সরকার মনোনীত প্রার্থী রমেন পোদ্দারকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাল্সেলর পদে অনুমোদন না দিয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যের নাম বাছাই করেন । অনিলানয়ন তখনও শুরু হয়নি, তবে শিক্ষাঙ্গনে শাসক ঘনিষ্ঠদের বসানোর কাজ তখন শুরু করছে বামেরা ৷ কাজেই মার্কসীয়দের পছন্দ ছিলেন দল ঘনিষ্ঠ রমেন পোদ্দার । অন্যদিকে কংগ্রেস-জনতা পার্টির পছন্দ ছিল সন্তোষ ভট্টাচার্য । এই ঘটনা নিয়ে বামফ্রন্টের ভিতরে তুমুল ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় ।
বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ডাকা বৈঠকে স্থির হয়, কেউ রাজ্যপালের সভায় যোগ দেবে না । জ্যোতি বসু নিজে সেই সময়ে রাজ্যপালের ডাকা একটি আইনি পরামর্শের বৈঠকে যাননি । এমনকি যাননি 10 জানুয়ারি নবনির্বাচিত মন্ত্রী নিহার বসুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও । এপি শর্মার যুক্তি ছিল, ভোটাভুটিতে সন্তোষ ভট্টাচার্য রমেন পোদ্দারের থেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তিনি যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । বামেরা আবার পাল্টা নজির টেনে এনে বলে, 1954 সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে বসেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, যিনি আদতে এই পদের অন্য দাবিদার বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর থেকে কম ভোট পেয়েছিলেন । অর্থাৎ ভোটাভুটিকে সেদিন গুরুত্ব দিতে চায়নি বামেরা ।
আরও পড়ুন : Controversial Remarks : ‘পুলিশ আমাদের’, ভাঙড়ে তৃণমূল যুবনেতার মন্তব্যে বিতর্ক
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও ক্ষোভের আগুন ছড়ায় । প্রথম দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা পান সন্তোষ ভট্টাচার্য । নিরন্তর বাধার মধ্যে সন্তোষ ভট্টাচার্য এই পদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু এপি শর্মাকে বয়কটের ডাক উঠতে থাকে বামেদের মধ্যে থেকে । 1984 সালেই তিনি বিদায় নিলে বাংলায় রাজ্যপাল হয়ে আসেন উমাশঙ্কর দীক্ষিত । মনে রাখতে হবে এই আটের দশকেই সাকারিয়া কমিশনের কাছে পাঠানো রিপোর্টে বামেরা বলেছিল, এই আলঙ্কারিক রাজ্যপাল পদটি রাখারই কোনও প্রয়োজন নেই ।
যদিও বর্তমান সময়ে এই রাজ্যপাল নিয়োগ নিয়ে এখনকার শাসক পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে আদৌ রাজ্যপাল পদ রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না । সবচেয়ে বড় কথা লাগাতার বিরোধিতা, সরকারি কাজে বাধা, বিধানসভার কাজে হস্তক্ষেপ এসবের পর সরকার প্রশ্ন তুলেছে রাজ্যপালের বিলাসবহুল জীবন নিয়ে । যেভাবে জগদীপ ধনকড়ের আমলে রাজ্যপালের খরচ বেড়েছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিয়েছে ।
আরও পড়ুন : Suvendu Adhikari : শোকে সুব্রতর স্মরণসভায় যাননি, অথচ পার্টিতে যান মমতা ; বিস্ফোরক শুভেন্দু
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘সংঘাতের ইতিহাস যতই থাকুক, যতই রাজ্যপালের পদকে অলংকারিক বলা হোক না কেন, তা সত্ত্বেও কোনভাবেই এই পদ তুলে দেওয়া যায় না । কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্যপালের আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে । একটা সরকার চলে গিয়ে যখন নতুন সরকার গঠিত হয় । এই মধ্যবর্তী সময়টায় রাজ্যপাল রাজ্য চালান । সবচেয়ে বড় কথা সংবিধানে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর এই দুই পদের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ের কাজ করা হয়েছে । সেক্ষেত্রে রাজ্যপালের পদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আসলে যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র তার বিরুদ্ধেই একটা প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দেয় ।’’