কলকাতা, 25 মে : ব্যস্ত শহরে নিত্যদিন লেগেই থাকে দুর্ঘটনা ৷ কিছু খবর জায়গা পায় গণমাধ্যমে, কিছু পুলিশি নথিতেই থেকে যায় ৷ তবে কলকাতা শহরে গড়ে পাঁচ-ছ’টি দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে ৷ লকডাউনের ফলে অনেকেই বিপদে পড়লেও কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে কলকাতা পুলিশ ৷ লকডাউনের ফলে কলকাতায় পথ দুর্ঘটনার হার কমেছে 90 শতাংশ ৷ লকডাউনের মাঝে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কেবল তিনজনের ৷
লকডাউনের 55 দিনে চিনা মাঞ্জায় মা ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনাটি ধরলে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি । এরপর 2 এপ্রিল ও 3 এপ্রিলে আরও দুটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৷ সে দিক থেকে দেখতে গেলেও শহরে দুর্ঘটনা কমেছে 90 শতাংশেরও বেশি । তবে যান চলাচলের ক্ষেত্রে লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই শহরে ফের বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা ।
গত 22 মার্চ জনতা কারফিউয়ের ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । সেদিন থেকেই ট্রেন চলাচল বন্ধ । ওই দিন থেকেই শহরে গাড়ির সংখ্যা কমে যায় হু হু করে । গত 24 মার্চ থেকে কলকাতায় চলছে লকডাউন । সেদিন থেকে শহরে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া কোনও বাস চলাচল করছে না । গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত । খোলা নেই অফিস কাছারি । কোরোনা ভাইরাসের ভয়ে রাস্তাতেও কম বের হচ্ছেন মানুষ । তার জেরেই দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে গেছে বলে মত লালবাজারের ।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত 22 মার্চ থেকে 10 এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতায় মাত্র দু’টি দুর্ঘটনা ঘটেছে । 22 মার্চ সরশুনায় গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর জখম হন এক মহিলা । হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার দু’দিন পর তার মৃত্যু হয় । 28 মার্চ শিয়ালদার মৌলালিতে বাসের সঙ্গে একটি গাড়ির ধাক্কা লাগে । পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে 11 এপ্রিল, বেহালার পাঠক পাড়ায় । একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে পথচারী 50 বছরের কালুয়া দেবীকে । তাকে ভর্তি করা হয় পর্ণশ্রী বিবেকানন্দ হাসপাতালে । পরে তিনি অবশ্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান । ওই একই দিনে পুলিশের একটি পিসিআর ভ্যান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে । সামান্য আহত হন ওই গাড়ির চালক অভিজিৎ মল্লিক । তিনি বি পি পোদ্দার হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে সুস্থ হয়ে ওঠেন । তারপরে গোটা এপ্রিল মাসে আর কোনও পথ দুর্ঘটনার খবর ছিল না ।
মে মাসে প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে 7 তারিখ । একটি টাটা সুমো সঙ্গে লাক্সারি ট্যাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে । সেই ঘটনায় ওই ট্যাক্সির আরোহী প্রসুন বিশ্বাস এবং দীপ্তনু ব্যানার্জি নামে দুজনেরই অল্প চোট লাগে । তাদের আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাদের ছেড়ে দেন । এরপরে 11 মে একটি সরকারি বাস ধাক্কা মারে এক পথচারীকে । ঘটনায় চোট পান ললিত রায় নামক এক ব্যক্তি । ওই একই দিনে বাসন্তী হাইওয়েতে একটি অ্যাপ ক্যাবের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোটরবাইকের । ঘটনায় বাইক আরোহী গুরুতর চোট পান । চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন উত্তম হালদার নামে 30 বছরের ওই যুবক, পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি । তারপরের পাঁচদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি ।
গত 16 মে শহরে প্রথম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আসে । তবে সেটি চিনা মাঞ্জার কারণে । সেদিন সন্ধ্যায় আখতার খান নামে 40 বছরের এক যুবক বাইকে করে সায়েন্স সিটির দিক থেকে পার্কসার্কাসের দিকে যাচ্ছিলেন । সেই সময় আচমকাই তার গলায় ঘুড়ির সুতো জড়িয়ে যায় । সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর গলা কেটে যায় । বাইক থেকে পড়ে যান তিনি । তাকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন । 17 মে অর্থাৎ তৃতীয় দফার লকডাউনের শেষদিনেও ঘটে ছোট একটি দুর্ঘটনা । সেই দুর্ঘটনাটি ঘটে মা ফ্লাইওভারে । মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান বাইকচালক । তাঁকে চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় ।
তৃতীয় দফার লকডাউনের পর রাজ্য সরকার যান চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়মে কিছুটা শিথিলতা এনেছে । তার জেরেই বেড়েছে দুর্ঘটনার সংখ্যা । রাতে ফাঁকা রাস্তার সুযোগ নিয়ে বেহালায় কার রেসিং করতে গিয়ে আহত হন চালকসহ চারজন । তাদের বিদ্যাসাগর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় । এদিকে 18 তারিখে ভবানীপুর ট্রাফিক গার্ডের 1 কনস্টেবল বাইক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন । আলিপুর ব্রিজে একটি গাড়ি তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা মারে । হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওই কনস্টেবলকে ছেড়ে দেওয়া হয় । সাউথ সিটি মলের কাছে আরও একটি বাইক দুর্ঘটনা ঘটে । একটি প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে বাইকের সংঘর্ষ হয় । ঘটনায় আহত হন সৌগত গুপ্ত বক্সী এবং বাইক আরোহী পূজা ভরদ্বাজ ।
19 মে দক্ষিণ বন্দর থানা এলাকার দমায়ুন অ্যাভিনিউ এবং সি জি আর রোডের সংযোগস্থলে একটি পণ্যবাহী গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোটরবাইকের । এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন মহম্মদ শরিফ নামে 47 বছরের এক ব্যক্তি । তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় । কিন্তু মাথায় চোট লেগে মৃত্যু হয় বাইক আরোহী 13 বছরের সোনালী খাতুনের । সেদিনই অপর এক দুর্ঘটনায় চারজন আহত হন । একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা মারে । এই ঘটনায় বিজয় মন্ডল, রাজু মন্ডল, পিন্টু বক্সী এবং সত্যেন মিদ্দে নামে চারজন আহত হন । তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । সোনারপুর রোডে অন্য এক পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন শেখ আব্বাস নামে 26 বছরের এক যুবক । গুরুতর আহত অবস্থায় ওই বাইক আরোহীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে।
হিসাব অনুযায়ী, তৃতীয় দফার লকডাউন পর্যন্ত গোটা কলকাতা শহরে দুর্ঘটনা ঘটেছে মাত্র সাতটি । চিনা মাঞ্জার কারণে মৃত্যু হয়েছে একজনের । এদিকে চতুর্থ দফার লকডাউন শুরুর প্রথম দুদিনেই দুর্ঘটনার সংখ্যা ছয় । মৃত্যু হয়েছে একজনের । এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) রুপেশ কুমার বলেন, “ লকডাউনে যেভাবে শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, তাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে গেছে ব্যাপক হারে । মৃত্যু নামিয়ে আনা হয়েছে প্রায় শূন্যে ৷ এটি একটি ভালো বিষয় ৷’’
কিন্তু কীভাবে বোঝা যাবে দুর্ঘটনার হার কমেছে? লালবাজারের তথ্য অনুযায়ী 2017 সালে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল 329 জনের ৷ 2018 সালে সংখ্যাটি ছিল 298 এবং 2019 সালে 267 জনের মৃত্যু হয় পথ দুর্ঘটনায় ৷ অর্থ্যাৎ বিগত বছরে মাসে গড়ে 23টি মৃত্যু হত পথ দুর্ঘটনায় ৷ অন্যদিকে 2018 সালে 2244টি পথ দুর্ঘটনায় 2162 জন আহত হন ৷ 2019 সালে 1804টি পথ দুর্ঘটনায় 2012 জন আহত হয়েছিলেন ৷ প্রতি মাসে গড়ে 168 জন আহত হয়েছেন বিগত বছরে ৷ লকডাউনের এই দুই মাসে আহত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে 13টি ও তিন ৷ এই পরিসংখ্যান দেখেই চোখ বুঝে বলা যায় কলকাতায় দুর্ঘটনার হার 90 শতাংশ কমেছে লকডাউনের ফলে ৷