কলকাতা, 28 মে: সারি সারি আম, কাঁঠালের গন্ধে ম ম করছে বাজার ৷ দোকানে দোকানে সাজানো রয়েছে লাল টুকটুকে লিচু ৷ একনজরে দেখলেই বোঝা যায়, জামাইষষ্ঠী উপলক্ষেই এই আয়োজন ৷ তবে এবারের চিত্রটা একটু আলাদা ৷ আমফানের ঝড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে অধিকাংশ ফল ৷ সবজি ও মাছ-মাংসের দামও আকাশছোঁয়া ৷ লকডাউনে এমনিতেই পকেটে টান, তার উপরে জামাই আপ্যায়নের সমস্ত উপকরণই অগ্নিমূল্য ৷ সব মিলিয়ে এই বছরের জামাইষষ্ঠী পুরোটাই মাটি ৷
অন্যান্য বছর আজকের দিনে শাশুড়ির দেওয়া ফর্দ হাতে ঝুলিয়ে বাজারে দৌড়ান শ্বশুর । বাজারের সেরা চিংড়ি, পাবদা, ইলিশটি বেছে বেছে কিনে আনেন জামাই বাবাজির জন্য । শাশুড়ির হাতের ছোঁয়ায় স্বাদ পায় মালাইকারি কিংবা ইলিশ ভাপা । কিন্তু এইবছর শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি থাকা জামাইদের ছাড়া বাকিদের আদর-অ্যাপায়নের উপায় প্রায় নেই বললেই চলে । কারণ, লকডাউন ৷ তাই এবছরের জামাইষষ্ঠী সম্পূর্ণ রংহীন বলা চলে ।
তবে শুধু বাড়িতেই ভিন্ন পদ রান্না করে জামাই অ্যাপায়ন নয়, বিগত কয়েক বছরে শহুরে শাশুড়িদের নতুন ফ্যাশন রেস্তরাঁয় টেবিল বুক করে জামাইদের খাওয়ানো ৷ খাটনিও কম, এদিকে জামাইরাও মনপসন্দ খাবার পেয়ে খুশি । সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সেরে নেন জামাইষষ্ঠীর বিশেষ ডিনার । কিন্তু এ বছর সেই উপায়ও নেই ।
সোদপুরের সুজন বোস । বিয়ে করেছেন এই বছরের জানুয়ারিতে । শ্বশুরবাড়ি বনগাঁয় । স্ত্রীর মুখে শুনেছেন শ্বশুরবাড়ির রীতি ঘটা করে জামাইষষ্ঠী পালন করা । পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সুজন বলেন, “ শ্বশুরবাড়িতে জামাই ষষ্ঠীর জাঁকজমকের গল্প শুনেছিলাম । ইচ্ছে ছিল প্রথমবার জামাই ষষ্ঠী করতে যাব । কিন্তু সে বাসনা পূর্ণ হল না । বনগাঁ যাওয়ার তো উপায় নেই । প্রথম বছরের জামাইষষ্ঠীটাই মাটি হয়ে গেল ।’’ অন্যদিকে সিঁথির মোড়ের রাহুল দত্তর শ্বশুরবাড়ি ভবানীপুরে । তাঁর শাশুড়ি জামাইষষ্ঠীর খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন রেস্তরাঁয় । কিন্তু এবার আর তা হবে না । তবে এইবার জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়িতে যেতেও চাইছেন না রাহুল । তিনি বলেন, “ছোট্ট মেয়ে রয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতে কোথাও না যাওয়াটাই ভালো । সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা উচিত । তার উপর বাইরে থেকে গিয়ে শ্বশুরবাড়ির আবাসনের অন্যান্য বাসিন্দাদের বিপদে ফেলতে চাই না । ওই আবাসনে আপাতত বাইরের লোকেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ । তাই এবার আর জামাইষষ্ঠী হবে না । তবে কি জানেন, জামাইষষ্ঠীর খাওয়া-দাওয়াটা মিস করব ।’’
জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁ বিশেষ মেনুর আয়োজন করে । জামাই আদরের পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়ে নেয় তারা । প্যাকেজ সিস্টেমে তৈরি করা হয় নানা রকমের থালি । পছন্দ আর পকেটের রেস্ত অনুযায়ী মেনু থেকে থালি বেছে নেন শাশুড়ি-জামাইরা । এইরকমই একটি রেস্তরাঁ উচ্ছ্বাস ৷ চাইনিজ় রেস্টুরেন্ট হলেও জামাইষষ্ঠীর জন্য চাইনিজ় হরেক পদের পাশাপাশি রাখেন নানা ধরনের বাঙালি পদ। জামাইকে পাত পেরে খাওয়াতে কী ধরনের মেনু করা হচ্ছে, তা নিয়ে কয়েকদিন আগেই বিজ্ঞাপন করে তারা । সেইমতো টেবিল বুকিংও নেওয়া হয় । রেস্তরাঁর কর্তা সুব্রত দে বলেন, “ মানুষজন আমাদের মূলত চাইনিজ় খাবার পছন্দ করলেও বিশেষ এই দিনটাতে প্রচুর টেবিল বুকিং হয় । আমরা বাঙালি নানা ধরনের খাবার পরিবেশন করি জামাইষষ্ঠীতে । স্টার্টার ও ওয়েলকাম ড্রিংক কম্প্লিমেন্টারি হিসেবে দেওয়া হয় । ব্যবসা একটা জিনিস, কিন্তু পারিবারিক এই আনন্দ অনুষ্ঠানে আমরাও কোথাও যেন একাত্ম হয়ে যাই । প্রচুর মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় । অনেক ক্ষেত্রেই তা চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হয়ে গেছে । কিন্তু লকডাউনে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠেছে । কর্মীদের মাইনে দিতে হচ্ছে, কিন্তু রেস্তরাঁ বন্ধ । আগামী দিনে কী হবে কে জানে?’’
দক্ষিণ কলকাতায় বাঙালি খাবারের অন্যতম সেরা ঠিকানা কলাপাতা । জামাইষষ্ঠীর দিনে দুপুরে কিংবা রাতে অনেকেই এখানে পাত পেরে খান বাঙালি হরেক পদ । ওই রেস্তরাঁর কর্তা বলেন, “অন্যান্যবার যেমন রেস্টুরেন্টে এসে মানুষজন খান, পাশাপাশি প্রচুর হোম ডেলিভারির অর্ডার পাওয়া যায় । জামাইষষ্ঠীর দিন প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে । কিন্তু এবার সেসব কিছুই নেই । হোম ডেলিভারির অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে না । আসলে কোরোনা আতঙ্কে মানুষজন বাইরের খাবার খাচ্ছেন না । ফলে আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি মার খাচ্ছে । কর্মীদের ঠিকমতো মাইনেও দিতে পারছি না । কর্মীরা মূলত ওড়িশার বাসিন্দা । আপাতত ওঁদের থাকা এবং খাবার ব্যবস্থাটা করতে পেরেছি । ট্রেন চলাচল শুরু হলে ওঁদের আর ধরে রাখতে পারব কি না, সেটাই চিন্তা । আগামী দিনে যে কী হবে, ভাবতেই পারছি না ।’’
জামাইষষ্ঠীতে প্রতিবছর অভিনব কিছু পদ আনা হয় মৎস্য দপ্তরের তরফ থেকে । গতবছর নলবন ফুড পার্কে রাখা হয়েছিল ঘটি জামাই ও বাঙাল জামাইদের জন্য বিভিন্ন পদ । স্মার্ট ফিশ নামে একটি অ্যাপেরও উদ্বোধন করা হয়েছিল জামাইষষ্ঠীর ঠিক আগে । সেই অ্যাপের মাধ্যমে জামাইষষ্ঠীর জন্য টেবিল বুকিং করা যাচ্ছিল । মাত্র 590 টাকাতেই পাওয়া যাচ্ছিল ঘটি জামাইদের জন্য বিশেষ থালি ৷ সেই থালিতে ছিল ভাত, কলাইয়ের ডাল, পোস্ত বড়া, মৌরলা মাছ ভাজা, তেল কই, পাতুরি, খয়রা মাছের তেল পেঁয়াজা, ট্যাংরা টক, পেঁপে দিয়ে চিংড়ির ঘণ্ট । অন্যদিকে বাঙাল জামাইদের থালিতে ছিল ভাত, মুগডাল, আলু ভাজা, চাপিলা মাছ ভাজা, সরষে ইলিশ, পোয়া মাছের পাতুরি, পাঁচফোড়নে কাতলা ভুনা, পালং সরষে দিয়ে সরপুঁটি । সব জামাইয়ের জন্যই শেষ পাতে ছিল দই, ফল এবং মিষ্টি । মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে এই ব্যবস্থাপনা রীতিমতো হিট হয়েছিল গতবছরে । এবার সেসব কিছুই করা যাচ্ছে না ।
মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ এ প্রসঙ্গে বলেন, “কিছুই করার নেই । অন্যান্য বছর আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে জামাইষষ্ঠীর দিনটা অন্যরকমভাবে পালন করি । কিন্তু এবছর এমনিতেই কোরানার সঙ্গে লড়াই চলছে, তারপরে আবার ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের দাপট । সবমিলিয়ে পরিস্থিতি একদমই হাতের বাইরে । এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব মানতেই হবে । তাই নলবন ফুড পার্ক খোলার কোনও উপায় নেই । আগামী দিনে নিশ্চয়ই ফের একইভাবে জামাইষষ্ঠীর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হবে । একটা বছর না হয় নাইবা হল । সকলে সুস্থ থাকুক এই কামনাই করছি ।’’