কলকাতা, 20 নভেম্বর: মার্কিন মুলুকে ট্রাম্প-বাইডেন দ্বৈরথ বা ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ৷ চায়ের আড্ডায় কোনও আলোচনাই বাদ পড়ে না । কিন্তু, যদি এমন একটা আড্ডা জমে যাতে আলোচনার বিষয়ই হল নাম না জানা রকমারি 'চা'! এক পেয়ালা ধুমায়িত চায়ে চুমুক দিয়ে আপনিও চাইলেই সেরে নিতে পারেন আপনার চা-চর্চা। চা নিয়ে আসন্ন শীতের জমাটি আড্ডা হতেই পারে যদি একবার ঢুঁ মারেন ই এম বাইপাসের ধারের 'নির্যাসে'। স্বাদ-সুগন্ধের অদ্ভুত মিশেলই হোক বা রকমারি চায়ের লম্বা তালিকা, পদে পদে চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য আপনার।
বাঁধাধরা জীবনের প্রতি অনীহা কার না আছে। নিয়ম মেনে অফিস কাছারিতে একেবারেই আগ্রহ ছিল না পার্থপ্রতিম গঙ্গোপাধ্যায়ের। অনীহা ছিল তাঁরও । হালকা মেজাজে একদিন বন্ধুদের তিনি বলেই ফেললেন, নেওয়া যাচ্ছে না আর এই গতে বাঁধা জীবন। বন্ধুদের পরামর্শ ছিল, "দিয়েই দে না একটা চায়ের দোকান"। ইয়ার্কির ছলে বন্ধুর দেওয়া পরামর্শ মনে ধরে যায় পার্থপ্রতিমবাবুর। তখনই ঠিক করেন চাকরি ছেড়ে এমন এক চায়ের দোকান দেবেন যেখানে রাজনীতির ময়দান থেকে খেলার মাঠের বদলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুই হবে রকমারি চা। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৪ সালে ই এম বাইপাসের ধারে মুকুন্দপুরে দুটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের বাইরে জন্ম নেয় 'নির্যাস'। মুকুন্দপুরে নেমে বাঁদিকের রাস্তা ধরে বেসরকারি হাসপাতালের সামনে দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই নজরে আসবে ডানহাতের ফুটপাতে একটি গাছতলায় বড় একটি ছাতার নিচে নির্যাসের স্টল। কলকাতার রাজপথে, অলিতে গলিতে থাকা অন্যান্য চায়ের ঠেকের থেকে যে এটি একটু ভিন্ন তা এক নজরেই ঠাওর করা যায়। সেই ভিন্নতাটা ঠিক কী তা জানতে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই ভেসে আসে সুগন্ধি বিভিন্ন চায়ের সুবাস। কখনও 'মাসকাটেলে'র চেনা অথচ অচেনা গন্ধ, আবার কখনও মাকাইবাড়ি চায়ের সুবাস। সেই সুগন্ধের টানেই বিগত ৬ বছর ধরে শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যের ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন ছোট্ট এই চায়ের স্টলটিতে।
বিগত ছয় বছরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে 'নির্যাসে'র কাহিনি। যা চা-প্রেমীদের জন্য অবশ্যই আর একটি ঠিকানা হয়ে উঠেছে। পথচলার শুরুতে বঙ্গের দার্জিলিং চা, যা সারা বিশ্ব এক নামে চেনে, তার রকমারি নিয়েই পসার বসিয়েছিলেন পার্থপ্রতিমবাবু। অন্যান্য চা-বিক্রেতার মতো মানুষকে ৩-৪-৫ টাকায় এক ভাঁড় চা পান করানোটা কোনও দিনই উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। তার বদলে একটু বেশি মূল্যে হলেও শ্রেষ্ঠ স্বাদটা মুখের স্বাদকোরক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই ভাবনাচিন্তা থেকেই রকমারি চায়ের সংগ্রহ বাড়াতে শুরু করেন তিনি । শুধু রাজ্য বা দেশের অন্যান্য জায়গার নয়, সংগ্রহে আনেন বিদেশেরও রকমারি চা। বর্তমানে পার্থপ্রতিমবাবুর সংগ্রহে প্রায় 117 রকমের চা রয়েছে। এই সকল রকমারি চায়ের এক পেয়ালার মূল্য 15 টাকা থেকে শুরু করে 1 হাজার টাকা পর্যন্ত। ভবিষ্যতে সংগ্রহে আরও দামি চা আনার পরিকল্পনাও রয়েছে পার্থপ্রতিমবাবুর।
চাকরি ছেড়ে চায়ের দোকান। এই পথচলা নিয়ে নির্যাসের মালিক পার্থপ্রতিম গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "কাজ করে পেট ভরছিল, কিন্তু মন ভরছিল না। ভাবছিলাম কী করা যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে, তাঁরা বলেছিল, 'তুই একটা চায়ের দোকান দিয়ে দে'। হয়ত মজার ছলেই বলেছিল কথাটা । আমি চিন্তা করে দেখলাম, এটা করা যেতেই পারে একটু অন্যভাবে। সেখান থেকেই ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি শুরু করি নির্যাস । প্রথমে আমার এখানে 10-12 রকমের দার্জিলিং চা ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ আসতে শুরু করল। তাঁদের অনেক প্রশ্ন । সেগুলোর উত্তর আমি দিতে শুরু করলাম । দিতে দিতে আমার একসময় মনে হল, এগুলো দিয়ে শুরু তো করেই ফেলেছি, এবার সারাবিশ্বে যাই ।" সেই ভাবনাচিন্তা থেকেই ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের চা আনা শুরু করেন তিনি।
চা-পানের বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য। ব্ল্যাক-টি, ওলং টি, ওয়াইট টি, গ্রিন টি সব চায়েরই গুণাগুণ নিয়ে হয়েছে বহু গবেষণা ও বহু গবেষণা এখনও চলছে। কিন্তু, সাধারণ মানুষের সেই সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম। পার্থপ্রতিম গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "ব্ল্য়াক টি, গ্রিন টি সম্পর্কে মানুষ জানে । অনেকেই জানে মাকাইবাড়ি, হ্যাপি ভ্যালি চায়ের কথা। কিন্তু, এর পাশাপাশি হারমুটি, অ্যাভন গ্রোভ, মিস্টভ্যালি, গিদ্দা পাহাড়, নীলগিরির প্রচুর ভালো ভালো চা রয়েছে । এগুলো সম্পর্কে কম মানুষই জানে । ভালো চা যেগুলো আমরা তৈরি করেছি, সেগুলো সারা বিশ্ব খাবে অথচ আমরা খাব না কেন? এই ধারণাটা আমার মাথায় প্রথম থেকেই ছিল এবং তা থেকেই আমার এই ব্যবসাটা শুরু করা । সারা পৃথিবীতে একটা কথা আছে যে, 'টি ক্যান ডু ওয়ান্ডারস'। এটা কিন্তু প্রমাণিত। ওই জায়গা থেকেই আমি ভাবলাম আমিও যদি সেগুলো আনতে পারি। আমার এখানকার মানুষ, আমার পরিবারকে চায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। তাতে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও পালন করা হল এবং নতুন ধরনের চা সম্পর্কে আমার বাঙালি ভাই-দাদারা জ্ঞান অর্জন করল।"
১৫ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দরে এক কাপ চা বিক্রি হয় নির্যাসে। বর্তমানে রাজ্য এবং বিশ্বের মোট ১১৭ রকমের চা রয়েছে এই দোকানে । নর্থ অ্যামেরিকা, সাউথ অ্যামেরিকা, ইউরোপ, প্যারাগুয়ে, নর্থ-ইস্ট এশিয়া, জাপান, চিন, কেনিয়া, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, টার্কি, এই রকম সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার চা নিয়ে এসেছেন তিনি। পার্থপ্রতিমবাবু বলেন, "আমার এখানে এমনও মানুষ আসেন যাঁরা জিজ্ঞেস করেন, ২ টাকার চা হবে দাদা? কিন্তু, সত্যিই কি ২ টাকায় এক কাপ ভালো চা তৈরি করা যায়? আমার এখানে ন্যূনতম চা যেটা পাওয়া যায় তার দাম ১৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ যেটা রয়েছে তার এক কাপের দাম সাড়ে ৯০০ বা হাজার টাকা। আগামীদিনে আমার এখান থেকেই এক কাপ চা সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা মূল্যেও পাওয়া যাবে? আর এত দামি চা অনেকেই খান। হাজার টাকার চায়ের নাম 'সিলভার নিডল হোয়াইট টি'। আমি ওটা জাপান থেকে আনিয়েছিলাম। এটা বিশ্বের পিওরেস্ট টি।"