কলকাতা, 22 অগাস্ট : খটকা লেগেছিল আরসালানকে গ্রেপ্তার করার পরেই । এত বড় দুর্ঘটনা তারপরও তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই ৷ এমনিতে দামি মডেলের জাগুয়ার গাড়িতে সুরক্ষা অনেক বেশি । তবে কি সেই রক্ষাকবচ সমস্ত চোট-আঘাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আরসালান পারভেজকে? কিন্তু তেমনটা হওয়ার তো কথা নয় । গাড়িতে থাকা এয়ারব্যাগ যদি চালককে বাঁচায় তবে তারও চিহ্ন থাকে । বেশ কিছুক্ষণ ধরে রোদে পোড়ার মতো মুখ লাল হয়ে যায় । মুখমণ্ডলের চারপাশে স্প্লিন্টার ইনজুরির মতো দাগ হয়ে যায় । কিন্তু আরসালানের মুখে তো তেমন কোন দাগ নেই ! সেই খটকা থেকেই শুরু হয় অন্যভাবে তদন্ত ।
গোয়েন্দারা বারবার জেরা করেন আরসালানকে । গোয়েন্দা সূত্রে খবর, তাঁর বক্তব্যে গরমিল পাওয়া যাচ্ছিল । তিনি যে কথা বলেন গোয়েন্দাদের সেই সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয় । দেখা হয় বিভিন্ন জায়গার CCTV ফুটেজ । গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন সত্যি বলছেন না আরসালান । তাঁকে আবারও জেরা করা হয় । বারবার জেরায় একটা সময় ভেঙে পড়েন আরসালান । পড়াশোনায় মেধাবী ছাত্রটি পুলিশকে শুধু বলেন, “গাড়িতে আমি ছিলাম না ।" মিলে যায় গোয়েন্দাদের সন্দেহ ।
না, আর কিছু বলেননি আরসালান । শুধু কেঁদে গেছেন অঝোরে । সেই কান্না দু'দিন ধরে থামছে না । অথচ, পরিবারের লোকজনের হাত ধরে তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন কলকাতা পুলিশের হাতে ।
জানা গেছে, ঘটনার পর পুলিশের তরফ থেকে পারভেজ পরিবারে নির্দিষ্ট ধারায় নোটিশ পাঠানো হয় । বলা হয়, ওই গাড়ি যে চালাচ্ছিল তাকে শেক্সপিয়ার সরণি থানায় দেখা করতে হবে । সেই নোটিশের সূত্র ধরেই পারভেজ পরিবারের তরফে আনা হয় আরসালানকে । বলা হয়, গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তিনিই । কিন্তু কেন এমন করতে গেল পারভেজ পরিবার?
ঘটনার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হয় ওই চত্বরের সমস্ত CCTV ফুটেজ । সেখানে দেখা যায় দুর্ঘটনার পর গাড়ি থেকে নেমে রীতিমতো দৌড়ে পালাচ্ছে একজন । পরপর CCTV ফুটেজে দেখা যায়, শেক্সপিয়র সরণি থানার সামনে কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে পার হওয়ার পর চালক ফের শুরু করছে দৌড় । কলামন্দিরের আগে ওই ব্যক্তি ধরে রডন স্ট্রিট । সেখানে পার্কোম্যাটের ফুটেজেও তাকে দেখা যায় ।
এতক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির মুখ খুব ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছিল না । কিন্তু পার্কোম্যাট ছাড়িয়ে পার্ক স্ট্রিটে পড়তেই একটি ব্যক্তিগত CCTV ক্যামেরায় যা ছবি ফুটে ওঠে, তিনি আরসালান নন । তবে কে তিনি?
গোয়েন্দারা এবার খতিয়ে দেখতে শুরু করেন পারভেজ পরিবারের CCTV ফুটেজ । সেই ফুটেছে আরসালানকে ওই সময়ের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়নি । বরং গাড়িতে যিনি গিয়ে বসলেন তিনি আরসালানের দাদা রাঘিব । তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় সবটা । মিলে যায় পার্কস্ট্রিটের CCTV ফুটেজের মুখ আর রাঘিবের ছবি । অথচ পুলিশি জেরায় পারভেজ পরিবার জানিয়েছিল রাঘিব রয়েছে দুবাইয়ে । তদন্তকারীরা বুঝে যান, মিথ্যে বলছে পারভেজ পরিবার । এদিকে ফুটেজ মিলে যাওয়া অকাট্য প্রমাণ নয় । সেই কারণে প্রয়োজন ছিল গাড়ির EDR-এর তথ্য ।
জাগুয়ার কর্তৃপক্ষের তরফে সেটি এনকোড করার পর কলকাতা পুলিশের ফরেনসিক এক্সপার্টরা সেখান থেকে “র ডেটা" বের করে আনেন । অত্যাধুনিক এই গাড়িতে যিনি ড্রাইভিং সিটে বসছেন তাঁর ফোন নম্বর এবং পাসওয়ার্ড না দিলে এই গাড়ি স্টার্ট নেয় না । সেই ভাবেই প্রোগ্রামিং করা ছিল । গাড়ি কে চালাচ্ছিল সেটাই প্রমাণ করতে পুলিশের এই তথ্যের প্রয়োজন ছিল । সেই তথ্য থেকে পাওয়া যায় রাঘিবের ফোন নম্বর । সেই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া যায় রাঘিবের ছবি । গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়ে যান এই ঘটনা ঘটিয়েছে আরসালানের দাদা । ইতিমধ্যেই লালবাজারে তথ্য আসে, দেশে ফিরেছেন রাঘিব । কিন্তু বাড়ি ফেরেননি । গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন তিনি । গতকাল দুপুর আড়াইটে নাগাদ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ । তাকে জেরা করতেই খুলে যায় অনেক জট ।
CCTV ফুটেজে আগেই দেখা গেছিল, গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে মধ্য কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরেছে । পরে বেপরোয়া গতিতে দুর্ঘটনা ঘটানোর পর রাঘিব নেমে যান গাড়ি থেকে । তারপর তিনি নিজের মামা মহম্মদ হামজাকে ফোন করেন । পরের দিন বিকেল পর্যন্ত তিনি মামার সঙ্গেই ছিলেন । বিকেলের বিমানে তিনি দুবাই চলে যান । সেখানে গিয়ে রাঘিব জানতে পারেন এই ঘটনায় তাঁর ভাইকে আত্মসমর্পণ করানো হয়েছে । মঙ্গলবার দুবাই থেকে কলকাতা ফেরেন তিনি । পরে নার্সিংহোমে ভরতি হয়ে যান । সেই সূত্রেই কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে হামজাকে ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, রাঘিব কলকাতায় থাকতেও কেন আরসালানকে আত্মসমর্পণ করানো হল? পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে আসার সময় হামজাও ওই পরিবারের দলে ছিলেন । কেন তিনি চেপে গেলেন সবটা? তবে কি এখানে কাজ করেছে কোন পাকা মাথার পরামর্শ? রাঘিব কি মদ্যপ অবশ্যই গাড়ি চালাচ্ছিলেন? আইন জানা সেই পরামর্শদাতা কি তবে বুঝে গেছিলেন, চালকের শরীরে মদ্যপ থাকার কোনও চিহ্ন যদি পুলিশ পায়, তবে কেস অনেকদূর গড়াবে । সেই সূত্রেই রাঘিবকে কয়েকদিনের জন্য ধরা ছোঁয়ার বাইরে পাঠিয়ে আরসালানকে আত্মসমর্পণ করানো হয়েছিল?
ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েকটা দিন । আরসালানের মুখে এয়ারব্যাগের চিহ্ন না থাকলেও, রাঘিবের মুখমণ্ডল থেকে তা মিলিয়ে যায়নি ।